শেষ পর্যন্ত আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যার্থ হলেন রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে দীর্ঘ এক যুগ পর বাগেরহাটের চাঞ্চল্যকর খান সাদেকুল ইসলাম ওরফে সাদু খাঁ হত্যা মামলার রায়ে অভিযোগপত্র ভুক্ত তিন জনই খালাস পেয়েছেন।
রোববার (২১ জুন) বিকেলে বাগেরহাট অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত-২ এর বিচারক আল্ আসাদ মো: আসিফুজ্জামান এই রায় ঘোষণা করেন।
দুর্বৃত্তের গুলিতে ২০১৩ সালে তৎকালীন বাগেরহাট জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার তেলিগাঁতি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাদু খাঁ নিহত হন।
অভিযোগ থেকে অব্যহতি পাওয়া এই তিন আসামী হলেন- বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার তেলিগাঁতি গ্রামের আব্দুল কাদের চৌধুরীর ছেলে আলমগীর হোসেন চৌধুরী, একই গ্রামের মৃত মোক্তার আলী খাঁর দুই ছেলে আকরাম খাঁ ও আশরাফ আলী খাঁ। রায় ঘোষণার সময় তারা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, মামলার এই পরিণতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহতের স্বজনসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীরা। তারা দলের নিবেদিত কর্মী হিসেবে পরিচিত সাদু খাঁ হত্যা মামলাটি আদালতে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করে এজন্য মামলা পরিচালনাকারী রাষ্ট্রপক্ষের কৌশলীসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতাকে দায়ী করেছেন।
ঘটনাটিকে দলের জন্য লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের কথা জানিয়েছেন নিহতের ভাই অ্যাডভোকেট খান শফিকুল ইসলাম।
২০০৩ সালের ১৩ নভেম্বর বিকেলে তেলিগাঁতি ইউনিয়ন পরিষদ থেকে রিক্সাযোগে বাগেরহাট শহরে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে সাইনবোর্ড-মোরেলগঞ্জ সড়কে কচুয়া উপজেলার গাবতলা এলাকায় দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন খান সাদেকুল ইসলাম ওরফে সাদু খাঁ।
সাদু খাঁ হত্যাকা- তখন বাগেরহাটসহ সারা দেশে বিশেষভাবে আলোচিত হয়। প্রশাসন মামলাটিকে চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে তদন্ত পরিচালনা করে।
২০০৪ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বাগেরহাট সফরে এসে শহরের বাসাবাটি এলাকায় সাদু খাঁর বাড়িতে যান। তিনি তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সহানুভুতি প্রদানের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে এই হত্যাকান্ডের যথাযথ বিচারের আশ্বাস দেন।
নিহত সাদু খাঁ’র স্ত্রী নার্গিস আক্তার রোববার এ রায়ের পর বাগেরহাট ইনফো ডটকম-এর কাছে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে আমার স্বামীকে চিনতেন। তিনি আমার বাড়িতে এসে এই হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন।’
‘কিন্তু আমরা সুবিচার বঞ্চিত হলাম। আমার দুই সন্তানের কাছে আমি কী জবাব দেবো ?’
মামলার নথি ও আদালত সূত্রে জানা যায়, সাদু খাঁ হত্যার ৩ দিন পর ২০০৩ সালের ১৬ নভেম্বর নিহতের ভাই শফিকুল আলম নান্টু কচুয়া থানায় ঐ তিন জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক শওকত আলী ঘটনার প্রায় চৌদ্দ মাস পর ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি ওই ৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন।
তবে, এর আগে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে চার দফায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়।
সূত্র জানায়, মামলার তদন্তকালে ঘটনার স্বাক্ষী হিসেবে রিক্সাচালকসহ অন্তত চার জন আদালতে জবানবন্দি দিয়ে ঘটনার বর্ণনা দেন। কিন্তু মামলার স্বাক্ষ্য গ্রহণকালে রাষ্ট্রপক্ষ এদের মধ্যে মাত্র একজনকে স্বাক্ষ্য প্রদানের জন্য আদালতে হাজির করাতে সক্ষম হন।
রোববার রায় ঘোষণার পর বাগেরহাট আদালত চত্ত্বরে আলাপকালে এই মামলার সাথে পরিচিত একাধিক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে শ্রমিক লীগ নেতা হত্যার এই মামলাটিকে অকার্যকর করার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিলো।
মামলার স্বাক্ষ্য পর্ব (আরগুমেন্ট) দুর্বল হওয়ায় পরিস্থিতি অভিযুক্তদের অনুকূলে চলে যায়। তাদের মতে, মামলার কাজে নিয়োজিত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এর দায় এড়াতে পারেন না।
বাগেরহাট জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ কামরুজ্জামান টুকু বলেন, ‘দীর্ঘ এক যুগ প্রতিক্ষার পর সাদু খাঁর মত একজন ত্যাগী কর্মীর পরিবারকে আমরা সুবিচার দিতে পারলাম না। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক। এক্ষেত্রে মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রপক্ষের কৌশলীদের ভূমিকা কী ছিলো, দল তা খুঁজে দেখবে।’
তবে এ রায়ের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি মামলার শেষ পর্যায়ে নিয়োজিত রাষ্ট্রপক্ষের কৌশলী ও বাগেরহাট আদালতের অতিরিক্ত পিপি লুৎফর রহমান।
বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি বলেন, ‘মামলার রায় সম্পর্কে আমি কথা বলবো না। তবে মামলা পরিচালনায় ব্যাক্তিগতভাবে আমার কোন অবহেলা ছিলো না। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা মামলাটির কোন পর্যায়ে বাদী ও আইনজীবীদের কি ধরণের তৎপরতা প্রয়োজন ছিলো তা বিশ্লেষণের বিষয়।’
এদিকে মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আসামী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী মো: মাহফিজার রহমান লাহু বলেন, ‘আমরা এই রায়ে খুশী। আমার মক্কেলরা নির্দোষ, তারা সুবিচার পেয়েছেন।’