বাগেরহাট মডেল থানার নৈশকালীন কতিপয় টহল পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অন্তত ৮টি মা ‘বক’ পাখিকে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে।
মারা যাওয়া মা বকগুলোর বাসায় থাকা বিভিন্ন বয়সের অন্তত ৮ জোড়া (বকের) ছানা এখন খাবার ও মাতৃস্নেহের অভাবে মরতে বসেছে। তবে এ বিষয়ে পুলিশের প্রথম বক্তব্য ‘অদ্ভুত ঘটনা’।
শুক্রবার (২৯ মে) দিবাগত গভীর রাতে বাগেরহাটের হযরত খান জাহান (রহ,)-এর মাজারের দিঘির মহিলা ঘাটের উত্তর পাশে ফকির শুকুর আলীর বাড়ির উঠানে এ ঘটনা ঘটে। শুকুর আলী মাজারের এক জন খাদেম।
বিশ্ব ঐতিহ্য খান জাহান (রহ.)এর মাজার কমপ্লেক্সের মত সংরক্ষিত স্থানে এমন ঘটনায় সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। আইন রক্ষাকারী পুলিশ সদস্যদের দ্বারা এভাবে বন আইন উপেক্ষা করে বন্যপ্রাণী হত্যার এমন ঘটনাকে কিছুতেই মেনে নিতে পাছেন না তারা।
ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের সনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামান বাচ্চু। তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হলে খারাপ মানুষেরা মাজার এলাকার গাছে গাছে থাকা বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপাখি হত্যায় উৎসাহিত হবে।’
এদিকে শুকুর আলীর পরিবারের সদস্যসহ মাজারের একাধিক ব্যক্তি পোষাকধারী পুলিশ সদস্যদের এয়ারগান দিয়ে এসব বক হত্যা করতে দেখলেও পুলিশ এখন ঘটনাটি স্বীকার করছে না। বরং বাগেরহাট মডেল থানার একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুঠোফোনে মাজারের ঐ খাদেমের কাছে ঘটনার জন্য দু:খ প্রকাশ করে বিষয়টি নিয়ে আর নাড়াচাড়া না করার পরামর্শ দেন।
শনিবার দুপুরে ওই এসআই-এর ফোন করার মুহূর্তে প্রতিবেদন তৈরীর জন্য এই প্রতিবেদক তখন সরেজমিনে ঘটনাস্থল শুকুর আলীর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।
শনিবার (৩০ মে) দুপুরে ঐ বাড়িতে যেয়ে দেখা যায়, বাড়ির গেটের পাশের মাঝারি একটি আম গাছের উপরের দিকে আট-নয়টি বকের বাসা। প্রতিটি বাসায় এক থেকে তিন সপ্তাহ বয়সী জোড়া জোড়া বকের ছানা খাদ্যের জন্য ডাকাযডাকি করছে। বাসাগুলোতে বড় কোন বক নেই।
প্রচ- রোদে এবং ক্ষুধায় বকের ছানাগুলো কাতর হয়ে পড়ছিলো। কয়েকটি ছানাকে বাসা ছেড়ে গাছের ডালে পাতার আড়াল খুঁজতে দেখা যায়।
বাড়ির কর্তা মাজারের খাদেম ফকির শুকুর আলী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, গত পাঁচ বছর ধরে তার বাড়ির দেবদারু ও আম গাছসহ বিভিন্ন গাছে প্রতি বছর প্রজননের সময় বকের দল এসে বাসা বাঁধে। ডিম পেড়ে ছানা ফুটিয়ে তারা আবার চলে যায়। তার তিনটি পোষা বক আছে। গাছ থেকে পড়ে যাওয়া বাচ্চা বড় করে তিনি তাদের শরীরে রং মেখে দিয়েছেন।
তারা সারাদিন বিভিন্ন স্থানে উড়ে খাবার খায়। সন্ধ্যায় তারা তার রান্নাঘরে এসে রাত কাটায়। এ বছর তার উঠানের আমগাছটিতেই নয়টি বাসায় দু’ তিন প্রজাতির বক বাসা বেঁধে বাচ্চা তুলছিলো।
তিনি জানান, শুক্রবার দিবাগত রাত আনুমানিক ২টার দিকে বাড়ির উঠানে চলাচলের শব্দ, টর্চের আলো ও এয়ারগানের গুলির ঠস্ ঠস্ শব্দ শুনে তার মা রহিমা খাতুন উঠে বের হন এবং পোশাক পরা দুই পুলিশ সদস্যকে টর্চের আলো বকের মুখে ফেলে আম গাছ থেকে গুলি করে বক হত্যা করতে দেখেন। এ সময় টহল দায়িত্বে থাকা ঐ পুলিশদের বহনকারী পুলিশ পিকআপটি মাজারের দিঘির সিঁড়ির কাছে দাড়িয়ে ছিলো।
রহিমা খাতুন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘আমি ওদের বাচ্চা বুকে থাকা বকগুলো মারতে মানা করি। কিন্তু তারা আমার কথা শোনেনি। গাছ তলায় কয়েকটা মৃত বক পড়ে ছিলো। কিছুক্ষণ পরে ওরা বকগুলো নিয়ে চলে যায়। এখন এই ছানাগুলোও হয়তো মারা যাবে।’
মাজারের নিরাপত্তা প্রহরী জাহাঙ্গীর শেখ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘পুলিশের টহল দল মাঝে মাঝেই রাতে মাজারের ঘাটে এসে কিছু সময় কাটায়। গত রাতে প্রহরার দায়িত্ব ছিলো খন্দকার রফিকুল ইসলাম নামে আরেক প্রহরীর। ভোরে তিনি যাবার সময় আমাকে বলেছেন, ‘‘শুকুর ফকিরের বাড়ির আমগাছ থেকে পুলিশ এয়ারগান দিয়ে গুলি করে কয়েকটি বক পাখি মেরে নিয়ে গেছে’’।
বাগেরহাট সদর থানার ঐ পুলিশ কর্মকর্তার সাথে মুঠোফোনে আলাপের পর ফকির শুকুর আলী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘থাক আপনারা কিছু লিখেন না। নাম শুনতে চেয়েন না। পুলিশ আমার উপর ক্ষেপে গেলে আমার বিপদ হবে।’
‘আমি বাচ্চা গুলো ধরে মাছ খাইয়ে বাচানোর চেষ্টা করবো।’
এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু এবারই না, কতিপয় পুলিশ সদস্য এর আগেও ঐ এলাকায় গভীর রাতে এয়ারগান দিয়ে বক শিকার করেছেন। মাজার এলাকার অধিবাসীরা মাঝে মাঝেই খুব ভোবে একজন পুলিশ সদস্যকে এয়ারগান নিয়ে মাজার এলাকায় পাখি শিকার করতে ঘুরে বেড়াতে দেখেন।
এলাকাবাসী তাকে পুলিশ সদস্য হিসেবে চিনলেও তার নাম কেউ বলতে পারেননি।
শুকার ফকির ও তার মা আরও বলেন, দশ-বারো দিন আগে গভীর রাতে টহলে আসা পুলিশ সদস্যরা তাদের বাড়ির দেবদারু গাছ থেকে এয়ারগান দিয়ে একটি বক হত্যা করে। বকটি গুলি খেয়ে উড়ে পাশের মৃত ওমর আলী ফকিরের উঠানে যেয়ে পড়ে। পুলিশ সদস্যরা ঐ বাড়ির লোকদের ডেকে তুলে বকটি চায়। ওমর আলীর স্ত্রী মিলি বেগম গেট না খুলে গেটের তলা দিয়ে মৃত পাখিটি তাদের দিয়ে দেন।
ফকির নজরুল ইসলাম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, সম্প্রতি এক ভোরে তিনি সাদা পোষাকে থাকা এক পুলিশ সদস্যকে এই এলাকায় এয়ারগান নিয়ে পাখি শিকারের জন্য ঘুরতে দেখেছেন। পুলিশ সদস্য বলে তিনি তাকে কিছু বলার সাহস করেননি।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার নিজামুল হক মোল্লা শনিবার সন্ধ্যায় বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘অদ্ভুত ঘটনা। আপনার কাছেই শুনলাম। পুলিশের কাছে তো এয়ারগান থাকে না, আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। ঘটনাটি কিভাবে ঘটলো বা কোন পুলিশ এমন ঘটনা ঘটালো সেটা আমি খুঁজে দেখবো।’