বেলা ১২টা। ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে বসে কম্পিউটারে একটি জন্ম সনদ বের করার জন্য অনলাইনে ডাটা এন্ট্রি করছেন উদ্যোক্তা রাসেল হাওলাদার।
হঠাৎ এক মহিলার আগমন। নাম মোসাম্মত ইলা আক্তার। ইউনিয়নের রনবিজয়পুর এলাকায় মৃত তাসেন সেখ মেয়ে ইলা।
ডিজিটাল সেন্টারে ঢুকেই রাসেলকে উদ্যেশ্য করে তিনি বললেন, ভাই বড় ঝামেলায় পড়েছি- উদ্ধার কর।
বিনয়ী রাসেল হাওলাদার ইলাকে সম্মোধন করে বললেন, আপা নো টেনশন, বলেন কি হয়েছে? ইলা হাফ ছেড়ে বাঁচে – চেয়ারে বসেই বলতে থাকে কৃষিব্যাংকে একাউন্ট রয়েছে। নাম সংশোধন করতে হবে- পাসপোর্টের নামের সাথে মিল রেখে।
রাসেলের ডাক্তারের মতো উত্তর, ওহ বুঝতে পেরেছি। ভুল করে দুই জায়গায় দুই রকম নাম হয়েছে, তাইতো? ইলা রাসেলের কথায় সায় দেয়।
রাসেল তার পাসপোর্টটি দেখতে চান। পরে পাসপোর্টের মোসাম্মাত ইলা আক্তার নাম ঠিক রেখেই কৃষিব্যাংকে একাউন্ট করার সময়ে ইজ্ঞলা আক্তার লেখা হয়েছে মর্মে একটি প্রত্যয়ন পত্র বের করে দেয় ইউনিয়ন পরিষদের প্যাডে। সবমিলিয়ে সাত মিনিট। ইলার কাজ শেষ – অর্থ বিনিময় মাত্র ১০টাকা।
কম্পিউটারে লেখা ও প্রিন্ট দিতে যতটুকু সময়। ইলা এবার বেজায় খুশি। অনেকটা উৎফুল মনে প্রত্যায়ন পত্র নিয়ে ডিজিটাল সেন্টার ত্যাগ করতে ব্যস্ত ইলা আক্তার।
এমন সময় তাকে প্রশ্ন করলাম, এখন কোথায় যাবেন? সাংবাদিক পরিচয় জেনে বললেন, ভাই দারুন সমস্যা আমার আজই ব্যাংক একাউন্ট হিসাব বিদেশে পাঠাতে হবে। কিন্ত পাসপোটের নামের সাথে ব্যাংক একাউন্ট পরিচালকের নামের গরমিল রয়েছে। ম্যানেজার সাহেব পাসপোর্ট দেখে বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যায়ন পত্র ছাড়া ব্যাংক হিসার সংশোধন করবেন না। তাই ছুটে এসেছি- খুব দ্রুত কাজ হয়ে গেছে, এখন ব্যাংকে যাব।
দুপুরের মধ্যে হয়তো ব্যাংকের ঝামেলা শেষ হবে- বলেই বেরিয়ে গেলেন ইলা আক্তার নামের ওই নারী।
এর কিছুক্ষন পর ওই ডিজিটাল সেন্টারে আসেন রনবিজয়পুর গ্রামের যুবক এনামুল হক। জরুরী ভিত্তিতে তার পাসপোর্টের কপি বিদেশে পাঠাতে হবে। বাড়ির পাশের এক বন্ধুর মাধ্যমে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে এই কাজের সুযোগ আছে শুনে ছুটে এসেছেন তিনি।
স্ক্যান করে খুব অ্ল্প সময়ের মধ্যেই তার পাসপোর্টের কপি বিদেশে ইমেই করতে পেরে খুশি মনে ফিরে যাচ্ছেন তিনি।
এনামূল শেখ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বললে, ধারণা ছিল না ইউনিয়ন পরিষদে প্রত্যায়ন পত্র, শালিস বিচার ছাড়া আর তেমন কোন সুযোগ মেলে। এতো সাচ্ছন্দে শহরে না গিয়ে গ্রাম পর্যায় থেকে একাজ করা সম্বভ হয়েছে ভাবতে অবাক লাগছে।
নয় বছর পর কাতার থেকে দেশে ফেরা এনামুলের ভাষ্য, এক আকাশ – পাতাল পার্থক্য ঘটে গেছে। এই সরকারের সময় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কেবলই শ্লোগানই নয়, বাস্তবে। এ সত্যি এক বিপ্লব।
উদ্যোক্তা রাসেল জানায়, ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রে আসা লোকদের একটি বড় অংশ আসে জন্ম সনদ, মৃত্যু সনদ, প্রত্যায়ন পত্র নিতে। আর এ কাজে প্রয়োজন হয় প্রিন্ট। এছাড়া ছবি তোলা, স্কাইপির মাধ্যমে বিদেশে কাথোপকথন, পরীক্ষার রেজাল্ট, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য ভর্তি ফরম, ই-মেইল করা, জরুরী কগজ পত্র স্কান করাসহ বিভিন্ন কাজ বিদ্যুৎ না থাকলেও সোলারের মাধ্যমে করতে পারছেন তারা।
উদ্যোক্তা রাসেল হাওলাদারের বয়স মাত্র কুঁড়ি। বাবার ছোট ব্যবসার উপার্জনে কোন মতে চলত রাসেলদের পরিবার।
ঠিক অভাব ছিলনা সংসারে, তবে স্বচ্ছলতার সু-বাতাসও ছিলনা। তাই তো কিছু একটা করে দেখাবার স্বপ্ন ছিলো রাসেলের চোখে। স্বপ্ন ছিল পড়াশুনার পাশাপাশি পরিবারকে সহযোগীতার।
গত ক’বছরে স্বপ্নের মতোই রাসেল বদলে দিয়েছে সবকিছু। শুধু পরিবারে অর্থের যোগান দিয়েই নয়। বদলে দিয়েছে গ্রামের সবার ভাবনা। বদলে দিয়েছে সবার চাহিদা।
রাসেলদের সংসারে এসেছে সৌখিনতা- নেই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে হতাশার ছাপ। আর এসব কিছুই সম্ভর হয়েছে উদ্যোমী রাসেলের প্রচেষ্ঠায়।
বাগেরহাট সদর উপজেলার রনবিজয়পুর গ্রামের রুস্তম হাওলাদারের ছেলে রাসেল হাওলাদার। উপজেলার ষাটগুম্বজ ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেবা কেন্দ্রের একজন সফল উদ্যোক্তা তিনি।
হাঁসি মুখে সবার প্রয়োজনে তথ্য সেবা পৌঁছে দিয়ে সুনাম কুড়ানো রাসেল এখন প্রতিমাসে আয় করছেন আট থেকে ১০ হাজার টাকা।
সরকারের তথ্য প্রযুক্তি তথা ডিজিটাল সেবার ছোয়ার রঙ্গিন হয়েছে রাসেলদের জীবন। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে কাজের ফাঁকে বাগেরহাটের খানজাহান আলী ডিগ্রী কলেজের কারীগরী শাখা থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেছেন তিনি।
গত প্রায় চার বছর ধরে ষাটগুম্বজ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা তিনি। তার আগে এক নারী উদ্যোক্তা ছিলেন এই কেন্দ্রে। বিবাহের সুবাধে ওই উদ্যোক্তার অনত্র চলে যাওয়াতে রাসেলের আগম ঘটে এই ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্রে (বর্তমান ডিজিটাল সেন্টারে)।
সেই থেকে এ কাজে জড়িয়ে পড়া। স্বকৃতি স্বরূপ ২০১৩ সালে জেলার মধ্যে সেরা উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
ডিজিটাল সেবা সাধারন মানুষের হাতের কাছে পৌঁছে দেওয়া উদ্যোক্তা রাসেল হাওলাদার জানান, এসএসসি পরীক্ষা শেষে চাচা স্বপন হাওলাদারের সহযোগিতায় কম্পিউটারে হাতে খড়ি তার। তারপর এগিযে চলা। অল্প সময়ের মধ্যে কম্পিউটার চালানো ই-মেইল করাসহ বেশ কিছু কাজ রপ্ত করেন।
এরই মধ্যে ষাটগুম্বজ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যায়। সেই থেকে তিনি এই ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ইউনিয়নবাসীকে সেবা দিয়ে আসছেন। বিনিময়ে সম্মানের সাথে আয় করছেন বেশ ভালো অর্থ।
ষাটগুম্বজ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের আরেক উদ্যোক্তা বনানী আক্তার। তিনিও প্রতিমাসে একই ধরনের তথ্য সহযোগিতা করে আয় করছেন আট/নয় হাজার টাকা।
ইউনিয়নের সুন্দরঘোনা গ্রামের সেকেন্দার আলীর বড় মেয়ে বনানী। পড়াশুনা করছেন বাগেরহাট সরকারী পিসি কলেজে। বর্তমানে স্নাতক ৩য় বর্ষের ছত্রী তিনি।
বাবা – মা ও নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া একমাত্র ভাইকে নিয়ে তাদের ছোট্ট সংসার। পিতা সেকেন্দার ঐতিহাসিক হয়রত খানজাহান (র.)-এর মাজার এলাকায় মুদি দোকানি।
ডিজিটাল সেন্টারে বসে মেয়েকে ল্যাপটপ-কম্পিউটার চালাতে দেখে আনন্দে আত্মহারা হন তিনি। সরকারের ডিজিটাল সেবার বদৌলতে তাদের সংসারে ফিরেছে সাছন্দ।
বাগেরহাট কারীগরি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে কম্পিউটার বিষয়ে ৬ মাসের প্রশিক্ষন নিয়েছেন বনানী।
গত তিন বছর ধরে ষাটগুম্বজ ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারে রাসেল হাওলাদারের মতো তথ্য সেবা প্রদানের কাজ করে আসছে বনানীও। গত ক’বছরে এলাকার তরুণদের মডেল হয়ে উঠেছেন এই দুই উদ্যোক্তা।
তাদের সফলতায় স্থানীয় অনেক তরুণই এখন শিখছে কম্পিউটার। অনেকে আজ করছেন আউটসোর্সিং এর।
কাজের ফাঁকে আলাপচারিতায় এই দুই তরুণ উদ্যোক্তা বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, সরকারে ডিজিটাল সেবা বিভিন্ন প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের মাছে পৌঁছে দিতে পারাতা সত্যিই আনন্দের। আর এর বিনিময় সামান্য অর্থ উপার্জন বেশ বজার ব্যাপার, গত ক’বছর ধরে বেশ উপভোগ করছি এই কাজ।
সদালাপী রাসেল হাওলাদার ও বনানী আক্তার ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে খুব দ্রুততার সাথে ই-মেইল করা, স্কাইপি’র মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ভিডিও কলিং, বিভিন্ন ওয়েব সাইট ব্রাইজ, পরীক্ষার ফলাফল জানা, পাসপোট ফর্ম পূরণ ছাড়াও বিদ্যুৎ বিল প্রদান, মোবাইল ব্যাংকিং সহ বিভিন্ন ধরণের তথ্য সেবা প্রদান করছেন ডিজিটাল সেন্টারে।
আর এ সকল কাজের মাধ্যমে সেবা নিতে আসা এলাকাবাসীর নিকট থেকে সামান্য ফি (টাকা) পায় তারা।
বনানী আক্তার বলেন, বর্তমানে ষাটগুম্বজ ডিজিটাল সেন্টারে গড়ে প্রতিদিন প্রায় চল্লিশ/পঞ্চাশ মানুষ ডিজিটাল সেবা নিতে আসেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের বিভিন্ন কাজ করে দেই। আর এর বিনিয়ম কাজের হিসাবে জনপ্রতি সরকার নির্ধারিত ফি (টাকা) পাই। আর এভাবেই প্রতিমাসে আট থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পরি।
শক্রবার বাদে সপ্তাহে ৬দিনই খোলা থাকে তারেদ ডিজিটাল সেন্টার। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে কাজ।
বনানী আক্তার বলেন, বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ আসে ডিজিটাল সেন্টারে। অনেকটা উৎকণ্ঠা নিয়ে সেবা কেন্দ্রে এসেই তাদের সমস্যার কথা বলতে থাকেন। এর পর আমরা তাদের প্রয়োজন অনুযাই ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে সমস্যার সমাধন করে থকি।
রাসেল জানায়, গ্রাহকের সমস্যার কথা শুনার পর দুই/ এক মিনিটের মধ্যে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন হবার খবর জানানো হয়। তখন তাদের চোখে মুখে অন্যরকম আলোর ঝলকানী, এককথায় তাদের আনন্দ দেখে ভালোই লাগে।
ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা রাসেল হাওলাদার ও বনানী আক্তারের সুনাম সুখ্যাতি এখন ষাটগুম্বজ ইউনিয়নবাসীর মুখে মুখে।
এ প্রসংগে কথা হয় ষাটগুমজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আকতারুজ্জামান বাচ্চুর সাথে। তিনি জানান, বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের অংশ হিসেবে তার ইউনিয়ন পরিষদে চালু হয় তথ্য সেবা কেন্দ্র। পরে যার নামকরণ করা হয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। এখানে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসে, এমনকি ইউনিয়নের বাইরের জনগনও এ কেন্দ্র থেকে তথ্য সেবা নিয়ে থাকেন।
যে প্রান্তের লোকই হোকনা কেন জরুরী প্রয়োজনে মানুষ তথ্য সেবা পাচ্ছে এটাই বড় কথা। আর সেবার বিনিময়ে যে অর্থ আয় হয় তার পুরোটাই উদ্যোক্তাদের দেয়া হয়। এছাড়া সব ধরনের সাপোর্ট দেয়া হয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকেই।
জনগনের জীবন মানের উন্নয়ন এই ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ত্বরান্বিত হচ্ছে। মানুষ সহজে সেবা পাচ্ছে। এটা গর্বের বিষয়।
তিনি আরো জানান, ২০১৩ সালে বাগেরহাট জেলার ৭৫টি ইউনিয়নের তথ্য সেবা কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের মধ্যে তাদের দু’জন সেরা উদ্যোক্তার পুরস্কার পেয়েছেণ। স্বীকৃতি স্বরূপ জেলা প্রশাসক আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের পুরস্কৃত করেছেন।
রাসেল- বনানীদের হাত ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্নের বাস্তবান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।