বাগেরহাটের ঐতিহাসিক হযরত খানজাহানের (রহ.) মাজারের দীঘির মিঠা পানির কুমিরের বিলুপ্তি ঠেকাতে উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
খানজাহানের শাসনামলে তার হাতে ছাড়া সর্বশেষ বংশধর কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড় বেঁচে থাকতে মিঠা পানির কুমিরের বিলুপ্তি ঠেকাতে ২০০৫ সালে ভারতের মাদ্রাজ ক্রোকোডাইল ব্যাংক থেকে ছয়টি কুমির এনে এই মাজারের দীঘিতে ছাড়া হয়। মাদধাজ থেকে এনে ছাড়া ওই কুমিরের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মারামারিতে কালাপাহাড় গুরুতর আহত হয়। এর কিছুদিন পর কালাপাহাড় মারা যায়। এরপর খানজাহানের হাতে ছাড়া অবশিষ্ট থাকে ধলাপাহাড়। সেটিও চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারী মারা যায়।
২০০৫ সালের ভারতের মাদধাজ ক্রোকোডাইল ব্যাংক থেকে এনে ছাড়া মিঠা পানির কুমির গত কয়েক বছর ধরে ডিম দিলেও তাতে নতুন করে কোন বাচ্চা ফুটছে না। ফলে এই দীঘিতে মিঠা পানির কুমির রক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা।
তাই এখন মিঠা পানির কুমিরের ডিম সংগ্রহ করে তা দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফুটানোর উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। আর এই কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফোটানোর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (ইনকিউবেটর) দিয়ে সহযোগিতা করছে বেসরকারী সংস্থা এসিআই।
মাজারের দীঘির দক্ষিণ পাড়ে একটি কুমির ২০/২৫ দিন আগে ৫৫টি ডিম পাড়ে। এই খবর পেয়ে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের একটি বিশেষজ্ঞ দল সেখানে গিয়ে ২২ ডিম সংগ্রহ করে তা দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চা ফুটাতে ইনকিউবেটরে বসানো হয়। এখন থেকে কুমির বিশেষজ্ঞরা সার্বক্ষণিক চোখ রাখবেন এই ইনকিউবেটরের দিকে। এই ডিম দিয়ে বাচ্চা ফুটবে কিনা সেজন্য আগামী ৪৫ দিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। এদিয়ে বাচ্চা ফুটলে তাদের নেয়া এই উদ্যোগ সফল হবে বলে মনে করছেন ওই কর্মকর্তারা।
ইতিহাস অনুযায়ী, হযরত খানজাহান (রহ:) সুলতানী শাসন আমলে খ্রীষ্টিয় ১৪ শতকের প্রথম দিকে বাগেরহাটে খলিফতাবাদ নগর রাস্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় তিনি ঠাকুর দিঘি নামে পরিচিত এই দিঘিটি সংস্কার করেন।
তিনি এই দিঘিতে ‘কালাপাহাড়’ ও ‘ধলাপাহাড়’ নামে মিঠা পানির প্রজাতির এক জোড়া কুমির পোষেন। তিনি তাদের নিয়মিত খাবার দিতেন, কুমির দুটি তাঁর হাত থেকে খাবার খেতো। তাঁর মৃত্যুর পরও মাজারের খাদেম ও ভক্তরা এই কুমির দুটিকে নিয়মিত খাবার দিতেন।
ক্রমে এই কুমির যুগল বংশ বিস্তার করে এবং গত সাতশ’ বছর ধরে বংশানুক্রমে তারা এই দিঘিতে উন্মুক্ত পরিবেশে বসবাস করে আসছিলো। এক সময়ে এই কুমির হযরত খান জাহানের ভক্ত অনুরাগীদের বিশ্বাস ও অনুভুতির প্রতিকে পরিণত হয়। এরা হয়ে ওঠে এই মাজার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংগ। মাজারের এই কুমির নিয়ে এলাকার মানুষের মুখে অনেক কিংবদন্তি ও লোককাহিনী শোনা যায়।
বেসরকারী সংস্থা এসিআই এর আঞ্চলিক বিক্রয় ব্যবস্থাপক মো. রশিদুল হাসান মৃধা বলেন, মিঠা পানির কুমিরের বিলুপ্ত ঠেকাতে আমাদের পক্ষ থেকে বিনামুল্যে কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চা ফুটানোর জন্য একটি ইনকিউবিটর দেয়া হয়েছে। এই ইনকিউবিটরে রাখা ডিম থেকে কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চা ফুটবে বলে আশা করছি।
প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক ডা. মো. নূরুল আমীন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ভারতের মাদ্রাজ ক্রোকোডাইল ব্যাংক থেকে এনে ছাড়া মিঠা পানির কুমির গত কয়েক বছর ধরে ডিম দিলেও তাতে নতুন করে কোন বাচ্চা ফুটছে না। ফলে এই দীঘিতে মিঠা পানির কুমির রক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে সংশ্লিষ্টরা।
তাই আমরা মিঠা পানির একটি কুমিরের পাড়া ৫৫টি ডিমের মধ্যে ২২টি ডিম সংগ্রহ করে তা দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফুটানোর উদ্যোগ নিয়েছি। মিঠা পানির কুমির বাংলাদেশ থেকে এরকেবারেই বিলুপ্ত হতে চলেছে। এবার খানজাহান (রহ.) দিঘির কুমিরের পাড়া ডিম থেকে প্রথমে ২২ ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে। তা ইনকিউটিবরে বসানো হয়েছে।
এই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটলে বিলুপ্ত প্রায় মিঠাপানির কুমির রক্ষা হবে। আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে বাচ্চা ফুটবে বলে আশাবাদ জানা তিনি।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাংগীর আলম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ঐতিহাসিক হযরত খানজাহানের (রহ.) স্মৃতিকে রক্ষা করতে কৃত্রিম উপায়ে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই উপায়ে যদি বাচ্চা ফুটানো সম্ভব হয় তাহলে বাংলাদেশের মিঠাপানির কুমির বংশ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।