বাগেরহাটের হযরত খনজাহান (রঃ) এর মাজার প্রাঙ্গনের শুরু হয়েছে তিন দিনব্যপী ঐতিহ্যবাহী খানজাহানের মেলা।
বৃহস্পতিবার (০২ এপ্রিল) বিকাল থেকে মাজার এবং সংলগ্ন ষাট গম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে বার্ষিক এ মেলা শুরু হয়েছে।
প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে বার্ষিক এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে দূরদূরান্তের দোকানীরা গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী পণ্যের বাহরী সম্ভার ও পসরা নিয়ে হাজির হয়েছেন মেলা প্রাঙ্গনে।
এরই মধ্যে আসতে শুরু করেছেন দেশি-বিদেশি ভক্ত, মুরীদ, আসেকান ও দর্শনার্থীরা। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল ভক্তবৃন্দের পদচারনায় মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে হযরত খনজাহান (রঃ) এর মাজার প্রাঙ্গন।
মাজারের প্রধান খাদেম শের আলী ফকির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, প্রায় ৬শ’ বছর ধরে হযরত খানজাহান (রঃ) এর মাজারে এই মেলা চলে আসছে। প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমার তিথিতে বার্ষিক এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে খনজাহানের হাজার হাজার ভক্ত, দর্শনার্থী, আসেকান, এবং পূর্ণার্থীরা দেশ বিদেশ থেকে মাজার প্রাঙ্গনে ছুটে আসেন।
মেলা উপলক্ষ্যে প্রতিদিন মাজার শরীফে আছর থেকে শুরু করে এশা পর্যন্ত ইছালে সাওয়াল (ওয়াজ) মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। সব ধর্মের মানুষ একটু পূর্ণলাভের আশায় হযরত খানজাহানের এই মেলায় ছুটে আসেন।
‘খানজাহানের মেলা’য় আসা বরগুনার ষাটউর্দ্ধো কদম আলী ফকির বলেন, ছোট বেলা থেকে প্রতি বছর এই পূর্ণিমা তিথিতে এখানে আসি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে আসা বাউল শিল্পীরা লালনগীতি, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালী, মারফতি গানের আসর জমান। মাজারের দীঘিরপাড়ে রাত ভর চলে গান বাজনা।
মেলার দর্শনার্থী মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল জলিল বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই মেলায় আসা হয়। প্রতি বছরই বাড়ছে মেলার পরিধি ও আর আগত দর্শনার্থীর সংখ্যা। এই মেলা আমাদের ঐহিত্য।
মাজারের আরেক খাদেম মনিরুল ফকির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, বাগেরহাট শহরতলীর খানজাহান (রঃ) মাজার শরীফের বার্ষিক এ মেলা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অন্যতম বৃহত মেলা। এই মেলা এ অঞ্চলের ঐতিহ্য।
মেলায় আসা দুর-দুরান্তের ভক্ত, দর্শনার্থীরা মাজার এলাকার বিস্তৃর্ণ স্থান জুড়ে যে যার মত করে তাদের আসর বসায়। মাজার সংশিষ্ট এলাকাসহ দেশ বিদেশের মুসলিম ফকির-আউলিয়া-দরবেশ, হিন্দু ধর্মাবলম্বী সাধু-সন্ন্যাসী, খৃষ্টান ও বৌদ্ধ ভক্তসহ সব শ্রেণীর মানুষের পদচারনায় আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠে এই এলাকা।
তিনি আরো জানান, এখানে আসা সকল শ্রেনীর মানুষ হযরত খানজাহান (রঃ) কে নিজেদের মত করে আরাধনা করেন। স্থানীয়দের কাছে বার্ষিক এই মেলা খানজাহানের “দর্গার মেলা” বলেও পরিচিত। অনেকে আবার খাঞ্জোলির মেলাও বলে।
বার্ষিক এ মেলা উপলক্ষে খুলনার দাকোপ থেকে মাজারে আসা অবনিশ মন্ডল বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথির জন্য অপেক্ষায় থাকি। এই দিনটি আসলেই এখানে চলে আসি। গত দশ বছর ধরে আমি এখানে আসছি।
‘এখানে নানা ধর্মের মানুষের একটা মিলন মেলায় পরিণত হয়। ধর্মাধর্ম ভুলে আমরা যদি সবাই এইভাবে থাকতে পারতাম তাহলে দেশের হিংসা হানাহানি বন্ধ হয়ে যেত।’
মেলা উপলক্ষ্যে তাল পাতার পাখা, বিভিন্ন তৈজসপত্র, শো-পিচ, কাপড়, মহিলাদের গৃহস্থালী ও সাজসজ্জ্বার আকর্ষনীয় সব সামগ্রী, টমটম, পুতুলসহ শিশুদের নানা রকমের খেলনা এবং নানা রকমের বাহারী সব পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানীরা।
মাজারের দিঘির ঘাটে তাল পাতার পাখা ও শিশুদের খেলনার দোকানী মরজিনা বেগম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আজ থেকে মেলা শুরু হলেও পুরোপুরি জমে উঠবে শুক্রবার থেকে। কাল (শুক্রবার) ভর মেলা। এই দিন এখানে লোক সমগম সবচেয়ে বেশি হবে।
ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামান বাচ্চু বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, এই মেলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অপূর্ব মিলন মেলা। দেশ বিদেশের হাজার হাজার মানুষ এই মেলায় আসেন।
আগামী ৫ এপ্রিল (মেলার শেষ দিন) মাজারের মসজিদে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দেশের দ্বিতীয় আধ্যাত্মিক সাধক খান-উল-আলম উলুঘ খান-ই-জাহানের মাজার প্রাঙ্গনে শুরু হওয়া ঐতিহ্যবাহী খানজাহানের মেলা।
তবে, শনিবার (৫ এপ্রিল) মেলার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও রীতি অনুযাই প্রায় ২/৩ দিন ‘ভাঙ্গা’ মেলা চলবে বলে জানান মেলা সংশ্লিষ্টরা।
হয়রত খানজাহান (রঃ)-এর মাজার তত্বাবধায়ক কমিটির সভাপতি ও বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোঃ জাহাংগীর আলম জানান, খানজাহানের মেলা উপলক্ষ্যে মাজার এলাকায় সার্বিক নিরাপত্তা ও আইন-শৃংখলা রক্ষায় মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুরদুরান্ত থেকে আসা দেশি-বিদেশি ভক্ত, দর্শনার্থীর জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে মেডিকেল টিমের।
এবারও উৎসব মুখর ও শান্তি পূর্ণ পরিবেশে ঐতিহ্যবাহী এই মেলা শেষ হবে বলে আশাবাদ জানান তিনি।