বাগেরহাটের মংলায় সেনাকল্যাণ সংস্থার সিমেন্ট কারখানায় একটি নির্মাণাধীন ভবন ধসে অন্তত ৬ শ্রমিক নিহত হয়েছেন।
‘মংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি’ নামের ওই কারখানার ধসে পড়া স্থাপনার নিচে এখনও বহু শ্রমিক আটকা পড়ে আছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এখনও উদ্ধার কাজ পুরোদমে চলছে। উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে তিন শ্রমিকের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন- বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার গৌরম্ভা গ্রামের আমীর আকুঞ্জী, একই উপজেলার রাজনগর গ্রামের মাহরুফ হাওলাদার এবং খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামের আল আমিন।
এছাড়া আহত অর্ধশতাধিক শ্রমিককে মংলা বন্দর হাসপাতাল ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে মংলা শিল্প এলাকায় বাংলাদেশ সেনা কল্যাণ সংস্থার মালিকানাধীন ‘এলিফ্যান্ট ব্রান্ড’ সিমেন্ট কারখানার নির্মাণাধীন ওই মিলিং হাউজের ছাদ ধসে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের বাগেরহাট স্টেশনের ইনচার্জ জয়নাল আবেদীন নয়ন ঘটনাস্থল থেকে জানান, সন্ধ্যা পর্যন্ত ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে তারা পাঁচটি মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন।
উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া খুলনা ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচারক মো. মিজানুর রহমান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, “ধ্বংসস্তূপে আরও অর্ধ শতাধিক শ্রমিক জীবিত বা মৃত অবস্থায় আটকে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।”
এরপর রাত ১১টার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে আরও একটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় বলে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুস সামাদ। নিহতের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও জানান, এ ঘটনা তদন্তে খুলনার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ফারুক হোসনকে প্রধান করে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এ কমিটিতে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি ও একজন প্রতিনিধি, খুলনা গণর্পূত বিভাগের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক এবং নির্বাহী প্রকৌশলী, সেনাকল্যাণ সংস্থার একজন প্রতিনিধি, খুলনা ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক, খুলনা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক, কোস্ট গার্ডের একজন প্রতিনিধি থাকবেন।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, সকালে ওই মিলিং হাউজের ছাদ ঢালাই শুরু হয়। ভবনটি প্রায় চার তলা ভবনের সমান উঁচু। শতাধিক শ্রমিক সে সময় কাজ করছিলেন।
“বেলা ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে কোনো এক সময়ে ঢালাই চলা অবস্থায় ছাদটি ধসে পড়ে। এতে বেশ কিছু শ্রমিক লোহার সেন্টারিং পাইপ, রড ও ঢালাই সামগ্রীর মধ্যে আটকা পড়েন।”
দুর্ঘটনার পরপরই সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ উদ্ধার কাজ শুরু করেন। ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়া অর্ধ শতাধিক আহত শ্রমিককে তারা উদ্ধার করেন।
এই নির্মাণ কাজের সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো, রফিকুল ইসলাম বলেন, আইটিসিএল নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তিনি এ নির্মাণ কাজের দেখভাল করছেন।
তিনি জানান, ভেঙে পড়া মিলিং হাউজের ছাদের আয়তন প্রায় চার হাজার ৬২ বর্গফুট। ৩৯ x ১০৮ বর্গফুট মাপের ভবনটি ৪২ ফুট উঁচু। সিমেন্ট কারখানায় এই মিলিং হাউজে ক্লিংকার গুঁড়ো করে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে কারখানার ভেতরে পাঠানো হয় বলে জানান তিনি।
তবে দুর্ঘটনার কারণ ও কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম নিজেকে অসুস্থ দাবি করে ফোন রেখে দেন।
মংলা বন্দর হাসপাতালের চিকিৎসক প্রকাশ চন্দ্র মণ্ডল জানান, নিহতদের মধ্যে চার জনের লাশ তার হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এছাড়া নয় শ্রমিককে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মো. মাশ্হুরুল হক জানান, ভবন ধসের ঘটনায় আহত ২৪ জন শ্রমিককে তার হাসপাতালে আনা হয়।
এদের মধ্যে রামপাল উপজেলার গৌরম্ভা গ্রামের শিহাব (৪০) নামে এক শ্রমিককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, সন্ধ্যার দিকে ধ্বংসস্তূপ থেকে পঞ্চম লাশটি উদ্ধার করা হয়। আলোর ব্যবস্থা করে রাতেও উদ্ধার অভিযান চালানো হচ্ছে।
তবে এ ঘটনায় কারখানার দায়িত্বশীল কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্যও আসেনি কোনো কর্মকর্তার পক্ষ থেকে।
আহত শ্রমিক মাসুদ কাজী ও গোলাম মোস্তফা জানান, ছাদের ওপর মশলা (ইট-শুরকির ঢালাই) দেওয়া হচ্ছিল। কাজ অর্ধেকটার বেশি এগিয়েও গিয়েছিল। হঠাৎ করেই বিকট শব্দে সব কিছু ভেঙে পড়ে।
ভবন ধসের খবর পেয়ে খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুস সামাদ, যশোর সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল মতিউর রহমান, বাগেরহাটের পুলিশ সুপার নিজামুল হক মোল্লা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
প্রধানমন্ত্রীর শোক
মংলায় সেনা কল্যাণ সংস্থার সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে নির্মাণাধীন স্থাপনা ধসে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
তিনি আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দিয়েছেন বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
সশস্ত্র বাহিনীর বক্তব্য
নির্মাণাধীন ভবন ধসের বিষয়ে আইএসপিআর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সেনাকল্যাণ সংস্থার সিমেন্ট প্ল্যান্টের সম্প্রসারণ প্রকল্প তথা তৃতীয় বল মিল নির্মাণ কাজ চীনভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিএনবিএম ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের সরসারি তত্ত্বাবধানে (টার্ন কি ভিত্তিতে) পরিচালিত হচ্ছে। নির্মাণ শেষে আগামী নভেম্বর মাসে মিলটি সেনাকল্যাণ সংস্থার কাছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক হস্তান্তরের কথা।
আইএসপিআর জানিয়েছে, প্রথম তলার কাজ চলাকালীন স্কাফল্ডিং এর ভারসাম্য হারিয়ে ঢালাইরত অংশ ধসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার অভিযান শুরু করা হয়।
ধ্বংসস্তূপ থেকে ৪৪ জনকে উদ্ধারের কথা জানিয়েছে আইএসপিআর, যার মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে।
আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা সিএমএইচ, যশোর সিএমএইচ ও খুলনার নৌবাহিনী হাসপাতাল প্রস্তুত রয়েছে বলে আইএসপিআর জানায়।
রাতে পাঠানো ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এখনও উদ্ধার কাজ পুরোদমে চলছে। উদ্ধার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে।
দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়াও হচ্ছে বলে আইএসপিআর জানিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনা তদন্তে সেনাকল্যাণ সংস্থা একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।