সুন্দরবনের গোলপাতা কুপ থেকে ফিরে:
বনদস্যুদের উৎপাত, কূপগুলোতে পাতার স্বল্পতা, বনবিভাগের কড়াকড়িসহ বিভিন্ন কারণে এবার সুন্দরবন থেকে গোলপাতা আহরণে আগ্রহ হারাচ্ছে বাওয়ালীরা।
চলতি মৌসুমে গোলপাতা আহরণে বাওয়ালীরা দেরিতে অনুমোদন নেওয়ায় পাতা আহরণ কমে যাবে। ফলে, গত মৌসুমের চেয়ে এবারে বনবিভাগের রাজস্ব আদায়ও কমবে যাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের।
তবে বিভিন্ন সময়ে গোলপাতা আহরণের সময় অতিরিক্ত পাতা ও বিভিন্ন ধরনের গাছ সংগ্রহেরও অভিযোগ রয়েছে বাওয়ালীদের বিরুদ্ধে।
প্রতিবছর ডিসেম্ব থেকে মার্চ মাস পর্যন্তই গোলপাতা আহরণ মৌসুম। এ সময় সুন্দরবনের আশপাশের অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গোলপাতা আহরণ, পরিবহন ও বিক্রির কাজ করে থাকে।
পূর্ব সুন্দরবনের ফরেস্ট রেঞ্জার ও চাদপাই স্টেশন (মংলা) অফিসার গাজী মতিয়ার রহমান বলেন, চলতি মৌসুমে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরনখোলা রেঞ্জের তিনটি, পশ্চিম সুন্দরবনের নলিয়ান ও বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জের তিনটি কূপের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ১০ লাখ মণ গোলপাতা আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি মণে ১২ টাকা হারে রাজস্ব আহরণ করা হবে।
তিনি জানান, বাওয়ালীরা এবার অনেক দেরি করে পাস নিয়েছে এতে তাদের গোলপাতা সংগ্রহের পরিমাণ কম হবে। এই কারণে আমাদের রাজস্ব আদায়ও কম হবে। ডাকাতের উপদ্রব অনেক বেশি থাকায় বাওয়ালীরা আসতেও ভয় পাচ্ছে। এ ছাড়া গোলপাতার কূপগুলোতে নিয়োজিত বন প্রহরীদের কাছে কোনো অস্ত্র নেই, তারপরও রয়েছে জনবল সংকট। সব মিলিয়ে নানা সমস্যার কারণে বাওয়ালীরা গোলপাতা আহরণে আগ্রহ হারাচ্ছে।
এদিকে শ্যালা গোলপাতা কূপ কর্মকর্তা মো. কবির হোসেন জানান, বনবিভাগের শতভাগ নিয়মকানুন মেনে বাওয়ালীরা গোলপাতা আহরণে আগ্রহী না। প্রতিবছর বাওয়ালীরা তাদের নৌকার ঝুল হিসেবে গেওয়া গাছসহ বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি নিয়ে বাড়তি আয় করে থাকত। কিন্তু এবার তা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে বাড়তি খরচ করে নৌকা ঝুল হিসেবে তাদের চাম্বল, সুপারিসহ বিভিন্ন গাছ কিনে ব্যবহার করতে হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এবার পাতা আহরণ ও রাজস্ব আদায় অনেক কম হবে বলে মনে করেন তিনি।
শরণখোলার বাওয়ালী জাকির হোসেন বলেন, এ বছর কূপগুলোতে পাতার পরিমাণ খুব কম। এছাড়া অন্যান্য বছর গোলপাতার নৌকায় ঝুল (নৌকার ভারসম্য রক্ষায় দুই পাশে ব্যবহৃত গাছ) হিসেবে বন থেকে কেটে নেওয়া বিভিন্ন প্রজাতির গাছ থেকেও তাদের বাড়তি আয় হতো। কিন্তু এবার তাও বন্ধ করে দিয়েছে বনবিভাগ, তাই আমাদের লোকসান হবে।
মংলার বাওয়ালী সবুর বলেন, চলতি গোলপাতা আহরণ মৌসুমে সুন্দরবনে ডাকাতের খুব উপদ্রব। আমরা যা আয় করি তার অর্ধেকই ডাকাতদের দিতে হয়। তা না হলে আমাদের লোকজন ধরে নিয়ে আটকে রেখে মারধর করে।
এদিকে মংলার আরেক বাওয়ালী আবুল হোসেন বলেন, আমরা ধার-দেনা করে নৌকা নিয়ে গোলপাতা কাটি এ দিয়ে আমাদের সংসার চলে। গোলপাতা না কাটলে পাতা এমনি এমনি নষ্ট হয়ে যায়।
বাওয়ালীরা আরো বলেন, প্রতিবছর নিয়ম মাফিক গোলপাতা সংগ্রহ করলে গোলগাছের পরিচর্যা হয় এবং এর পরিমাণও বেড়ে যায়। আর সময় মতো গোলপাতা কাটা ও সংগ্রহ করা না হলে পাতা নষ্ট হয়ে গোলপাতার বাগানে মড়ক ও ঝার ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগীয় কার্যালয়ের অফিস সহকারী সাত্তার হাওলাদার বলেন, চলতি মৌসুমে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের চাঁদপাই গোলপাতা কূপ থেকে ৩৩ হাজার কুইন্টাল, শ্যালা কূপ থেকে ৫৩ হাজার ও শরণখোলা রেঞ্জের শরণখোলা কূপ থেকে ৭২ হাজার কুইন্টাল গোলপাতা আহরণের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে চলতি মৌসুমের এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ পাতা আহরণ করা হয়েছে এবং রাজস্ব আদায় হয়েছে তার তথ্য বিভিন্ন কূপ থেকে এখনো বিভাগীয় দপ্তরে আসেনি।
তিনি বলেন, প্রতিবছর ডিসেম্বরের আগে থেকেই বাওয়ালীদের গোলপাতা আহরণের পাস সংগ্রহের হিড়িক পড়লেও চলতি বছর বাওয়ালীরা এসেছে জানুয়ারির শেষের দিকে। আর গোলপাতা আহরণ শুরু করেছে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে। তাই অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার চার ভাগের এক কিংবা তার কিছু বেশি পাতা আহরিত হতে পারে।
সাত্তার হাওলাদার জানান, গত মৌসুমে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই, শ্যালা ও শরণখোলা কূপ থেকে মোট ৭৪ হাজার কুইন্টাল গোলপাতা আহরণ করা হয়েছিল। আর এতে রাজস্ব আয় হয়েছিল ২০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।