বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী হয়রত খান জাহান (র.) এর মাজারের দিঘির শতবর্ষী কুমির ‘ধলা পাহাড়’ মারা গেছে।
বৃহস্পতিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে দিঘির উত্তর-পশ্চিম দিকে পাড়ের কাছে পানিতে কুমিরটির মৃতদেহ ভাসতে দেখে পাড়ের বাসিন্দারা।
স্থানীয় খাদেমদের মতে, কুমিরটির বয়স হয়েছিলো প্রায় এক শত বছর। মৃত কুমিরটি লম্বায় প্রায় ৯ ফুট।
জেলা প্রশাসন ও বন বিভাপড়া পক্ষ থেকে কুমিরটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
‘ধলা পাহাড়’ এর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হযরত খান জাহান (র:) এর মাজারের দিঘিতে প্রায় সাত শত বছর ধরে প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকা মিঠা পানির কুমির যুগল ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ এর ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটলো।
এই দিঘিতে এখন ভারতের মাদ্রাজ ক্রোকোডাইল ব্যাঙ্ক থেকে ২০০৫ সালে আনা এই প্রজাতির দুটি কুমির রয়েছে।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সরেজমিনে এলাকাবাসী ও মাজারের খাদেমদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ভোরে দিঘিতে পানি নিতে আসা লোকেরা মৃত কুমিরটিকে ভেসে থাকতে দেখেন। খাদেমরা খবর জানার পর স্থানীয় ষাটগম্বুজ ইউপি চেয়ারম্যান ও বাগেরহাট সদর থানা পুলিশে খবর দেয়া হয়।
বেলা ১২টার দিকে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কুমিরটিকে টেনে পাড়ে তোলা হয়।
তাৎক্ষনিকভাবে ‘ধলা পাহাড়’র মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে দিঘিতে অবৈধভাবে মাছ শিকার করার জন্য পেতে রাখা ফাঁস জালে জড়িয়ে অথবা অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের কারণে শরীরে চর্বি জমে প্যান স্ট্যাটিস (Pan Statits) রোগে আক্রান্ত হয়ে কুমিরটির মৃত্যু হতে পারে।
জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সুখেন্দু শেখর গাইন মৃত কুমিরটি পর্যবেক্ষণ করে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, জেলা প্রশাসন কুমিরটির মৃতদেহ ময়না তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে। ময়না তদন্ত শেষে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা সম্ভব হবে।
এই প্রজাতির মিঠা পানির কুমির সাধারণত ১১ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমির হোসাইন চৌধুরী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, হযরত খান জাহানের (র:) দিঘির এই কুমির দেশে বিদেশে মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। এটি বিরল প্রজাতির মিঠা পানির কুমির। আমাদের দেশে উন্মুক্ত পরিবেশে সম্ভবত এটিই ছিলো এই প্রজাতির সর্বশেষ কুমির। তাই আমরা কুমিরটির চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করে সংরক্ষণের জন্য ষাটগম্বুজ যাদুঘরে হস্তান্তরের উদ্যোগ নিয়েছি।
বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ও যাদুঘরের কিউরেটর মো: গোলাম ফেরদৌস বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, খ্রীষ্টিয় ১৪০১ সালে এই অঞ্চলে হযরত খান জাহান (র:) এর আগমন, খলিফতাবাদ নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও খান জাহান পরবর্তি ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে মাজারের দিঘির কুমিরযুগল ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ এবং তাদের পরবর্তি বংশানুক্রমের ইতিহাস অবিচ্ছেদ্যবাবে জড়িত।
এই কুমির এখন বাগেরহাটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। তাই জেলা প্রশাসন ও সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের সহযোগিতায় আমরা কুমিরের এই চামড়াটি প্রক্রিয়াকরণের পর স্টাফড্ করে আমাদের যাদুঘরে দর্শনার্থীদের জন্য সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নয়েছি। সেই সাথে আমরা এর কংকালটিও প্রক্রিয়াকরণেল জন্য চেষ্টা করছি।
ইতিহাস অনুযায়ী, হযরত খান জাহান (র:) সুলতানী শাসন আমলে খ্রীষ্টিয় ১৪ শতকের প্রথম দিকে বাগেরহাটে খলিফতাবাদ নগর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় তিনি সে সময় একটি দিধি খনন করেন। মতান্তরে এলাকার ঠাকুর দিঘি নামে পরিচিত একটি দিঘিটি সংস্কার করেন।
খান জাহানের দিঘি নামে পরিচিত এই দিঘিতে ‘কালা পাহাড়’ ও ‘ধলা পাহাড়’ নামে মিঠা পানির প্রজাতির এক জোড়া কুমির পোষেন। তিনি তাদের নিয়মিত খাবার দিতেন, কুমির দুটি তাঁর হাত থেকে খাবার খেতো।
খান-উল-আলম উলুঘ খান-ই-জাহানের মৃত্যুর পরও মাজারের খাদেম ও ভক্তরা এই কুমির দুটিকে নিয়মিত খাবার দিতেন। ক্রমে এই কুমির যুগল বংশ বিস্তার করে এবং গত সাতশ’ বছর ধরে বংশানুক্রমে তারা এই দিঘিতে উন্মুক্ত পরিবেশে বসবাস করে আসছিলো। এক সময়ে এই কুমির হযরত খান জাহানের ভক্ত অনুরাগীদের বিশ্বাস ও অনুভুতির প্রতিকে পরিণত হয়। এরা হয়ে ওঠে এই মাজার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংগ।
মাজারের এই কুমির নিয়ে এলাকার মানুষের মুখে অনেক কিংবদন্তি ও লোককাহিনী শোনা যায়।
ইতিপূর্বে ১৯৮৪ সালের দিকে মাজার থেকে রাজশাহী চিড়িয়া খানাসহ দেশে বেশ কয়েকটি চিড়িয়া খানায় এই কুমির নেওয়া হয়েছিল। সেখানে কোথাও এই প্রজাতির ওই কুমির থাকলে তা এনে আবারও মাজারে ছাড়তে সরকারের প্রতি দাবি জানান অনেকে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর আলম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, জেলা প্রশাসন ও সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের সহযোগিতায় তারা কুমিরের কঙ্কাল ও চামড়া ষাটগম্বুজ জাদুঘরে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন।