মংলা সমুদ্র বন্দরের আন্তর্জাতিক নৌ-পথ মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার ভরাট হয়ে যাওয়া দাউদখালী নদীতে খনন কাজ শুরু হয়েছে।
বুধবার (২৮ জানুয়ারি) বিকেলে আনুষ্ঠানিক ভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এই নদী খনন কাছের উদ্বোধন করেন বাগেরহাট-৩ (রামপাল-মংলা) আসনের সংসদ সদস্য তালুকদার আব্দুল খালেক।
১৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন ৩৪/২ পোল্ডার প্রকল্পের আওতায় ১৭ নদী-খাল খনন কাজের অংশ হিসেবে দাউদখালী নদীর ১৫ কি.মি. নদী খনন করা হচ্ছে। এতে ব্যয় হবে ৮ কোটি ১০ লাখ টাকা। পোল্ডার প্রকল্পের আওতায় পঞ্চাশ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ১১০ কি.মি. নদী ও খাল আগামী জুন মাসের মধ্যে খনন করার কথা রয়েছে।
বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক নৌ-প্রটোকলভুক্ত মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-পথের রামপাল অংশে কুমারখালী নদীর সাথে সংযুক্ত দাউদখালী নদীর খনন খনন কাজ সম্পন্ন হলে আন্তর্জাতিক ঐ নৌ-পথটি আরও কার্যকর হয়ে উঠবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
বর্তমানে নাব্যতা হারিয়ে মৃতপ্রায় মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথটি কার্যকর করতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) তিন শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে ২২ কি.মি. পথ খনন করছে। এই খনন কাজও চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে শেষ হবার কথা।
বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, ঘষিয়াখালী খালটি কোনো খনন ছাড়াই ৪০ বছর ধরে নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই নৌপথের দুই পাশে ছোট-বড় প্রায় সাড়ে ৩০০ নদী-খাল রয়েছে। এগুলোই ছিল মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথের নাব্যতা রক্ষার প্রধান সহায়ক। কিন্তু দীর্ঘ্য দিনের দখতে এখন সে সব নদী খালগুলো অস্তিত্য সংঘটে পড়েছে।
মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথ সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মংলা নদীর ডান পাশে নদীসংলগ্ন চরে উপজেলার মাছমারা, নারকেলতলা, মাকড়ঢোন ও উলুবুনিয়া এলাকায় গড়ে উঠেছে সাতটি সরকারি আবাসন প্রকল্প। উলুবুনিয়া ও বুড়িরডাঙ্গা এলাকায় একেবারে নদীসংলগ্ন চরে মাটি ভরাট শেষ। খুব শিগগির সেখানে আরও দুটি আবাসন প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
একইভাবে রামপাল নদীসংলগ্ন উপজেলায় সিকিরডাঙ্গা আবাসন প্রকল্প-১, সিকিরডাঙ্গা আবাসন প্রকল্প-২ ও বাঁশতলী আবাসন প্রকল্প নামে আরও তিনটি সরকারি আবাসন প্রকল্প রয়েছে। আর দাউদখালী নদীতে রয়েছে শ্রীফলতলা আশ্রয়ণ প্রকল্প, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) আমাদের গ্রাম এর ক্যান্সার কেয়ার (হাসপাতাল) প্রকল্প। এ আবাসন প্রকল্পে প্রায় এক হাজার দরিদ্র পরিবার বসবাস করছে। ২০০৭ সাল থেকে এসব আবাসন গড়ার কাজ শুরু হয়।
মংলা উপজেলার মালগাজী এলাকার তহশিলদার টিটুল কুমার মণ্ডল বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘এস এ রেকর্ড অনুযায়ী ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা রেখেই নদী তীরবর্তী যে জায়গা আমরা খাস হিসেবে চিহ্নিত করেছি, তার মধ্যে এসব আবাসন প্রকল্প ও গুচ্ছগ্রাম সহ অনান্য প্রকল্পের অনুমদন দেওয়া হয়েছে।’
উপকূলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র নিয়ে কাজ করা স্থানীয় এনজিও সিডিপির খুনলা বিভাগীয় কোয়াডিনেটর এসএম ইকবাল হোসেন বিপ্লব বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, দীর্ঘ্যদিন ধরে দখলের কারে আন্তর্জাতিক এই নৌচ্যানের সংলগ্ন ছোট বড় ৩০০ থেকে ৩৫০ নদী-খাল এখন মৃত প্রায়। দখলের মাত্রা এখন এমন যে বাস্তবে বেশির ভাগরেই অস্তিত্য খুঁজে পওয়া যায় না।
খনন শুরু হওয়া দাউদখালী নদীটি প্রায় ৬০০ ফুট চওড়া ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন এ নদীর বিভিন্ন এলাকাজুড়ে রয়েছে বড় বড় প্রকল্প। তাই খনন হচ্ছে খুব সামান্য। নদীর স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে না দিলে নদী বাঁচবে না।
তার মতে, এই সব নদী খাল দখল মুক্ত করে পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে না পারলে মংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ-পথ পূনরূদ্ধার কাজ কেবলই অর্থের অপচয় হবে।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাইনদ্দীন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘সম্প্রতি সুন্দরবনে তেলবাহী ট্যাঙ্কারডুবির পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা ৩৪/২ প্রকল্পের স্লুইস গেট ও রেগুলেটর নির্মাণ কাজ স্থগিত রেখেছি। এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্প এলাকাভুক্ত নদী-খাল খনন কাজ শুরু করা হলো। মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের পাশে অবস্থিত এই প্রকল্পের অন্তর্গত নদী-খালে ঐ চ্যানেলের জোয়ার-ভাটার পানি চলাচল করতে পারলে চ্যানেলটি চালু থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের কাজের অংশ হিসেবে দাউদখালী নদীর শ্রীফলতলা থেকে ফয়লা স্লুইসগেট পর্যন্ত পনের কি.মি. পথ এখন খনন করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে দাউদখালী নদীর বাকি অংশসহ মোট ১৭টি নদী-খাল খনন করা হবে। এ জন্য ব্যয় হবে প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকা। এই নদী-খালগুলো খনন শেষে পানি চলাচল নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পশুর ও কুমারখালী নদীর নাব্যতা দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হবে।
এই কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট পাউবো’র কর্মকর্তা এবং এস্কিভেটর চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, একসাথে সাতটি এস্কিভেটর মাটি ওঠানোর কাজ করবে। দাউদখালী নদীর শ্রীফলতলা অংশে প্রায় দেড় শত ফুট এবং ফয়লা অংশে প্রায় ৭৫ ফুট চওড়া এবং দশ থেকে পনের ফুট গভীর করে নদীর বুক কাটা হবে।
খনন এলাকায় নদীর দুই পাশে দশ মিটার দূরত্বে খনন করে ওঠানো মাটি স্তুপ (ডাম্পিং) করা হবে বলে জনান তারা।
বুধবার বিকেলে শ্রীফলতলা আদর্শ গ্রামের পাশে পাউবো খুলনার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বজলুর রশিদের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন – রামপাল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আবু সাঈদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল ওহাব, পাউবো বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাঈনদ্দীন, রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু রাফা মোহম্মদ আরিফ, রামপাল সদর ইউপি চেয়ারম্যান বজলুর রহমান প্রমুখ।