‘বনবিবি’। সুন্দরবনজীবীদের কাছে পূজিত এক নারীশক্তি। বনজীবী বিশ্বাসী জেলে, বাওয়ালি আর মৌয়ালদের তিনি সুরক্ষার দেবী।
এই সুরক্ষা বনের বাঘ এবং বাঘরূপী অপশক্তি ‘দক্ষিণ রায়’ বা ‘রায়মণির’ হাত থেকে। যেমনটি পেয়েছিল সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ শিশুচরিত্র দুঃখে, বহু শত বছর আগে।
ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিবছরের মতো ১৬ জানুয়ারি শুক্রবার বাংলা বছরের পয়লা মাঘ (পঞ্জিকামতে) সুন্দরবনের ভেতরে আর বনসংলগ্ন লোকালয়ে ‘মা বনবিবি’র পূজা হয়েছে। এই পূজা দক্ষিণ বাংলার আবহমান লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ এই অঞ্চলের যেসব স্থানে বনবিবির পূজা হয়, তার মধ্যে অন্যতম খুলনার দাকোপ উপজেলার বাণীশান্তা ইউনিয়নের সুন্দরবনসংলগ্ন ঢাংমারী গ্রাম। একটি খাল দিয়ে গ্রাম আর বনের সীমানা। এই গ্রামের পূর্ব ঢাংমারী সর্বজনীন বনবিবি মন্দিরের পুরোহিত মধুসূদন মণ্ডল (৬১)। শুক্রবার এই মন্দিরে অনুষ্ঠিত বনবিবির পূজার পুরোহিত ছিলেন তিনি। এখানে খ্রিষ্টীয় ১৮৯৬ সাল থেকে বনবিবির পূজা হচ্ছে বলে মধুসূদন জানান।
‘আমি বনবিবির মন্দিরে উত্তরাধিকারসূত্রে পৌরোহিত্য করছি। বনসংলগ্ন লোকালয় এবং বনের ভেতরে প্রতিবছর দুই হাজারের বেশি স্থানে বনবিবির পূজা হয়। ঢাংমারীসহ শুধু পশুর নদের পশ্চিম পারে ভদ্রা নদী পর্যন্ত এলাকায় এ বছর বনবিবির তিন শতাধিক পূজা হয়েছে।’ বলেন মধুসূদন।
পূজামণ্ডপে বনবিবির প্রতিমার সঙ্গে থাকে বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গলী, গাজী আউলিয়া, শিশু দুঃখে, তার দুই চাচা ধন আর মন-এর প্রতিমা এবং দক্ষিণ রায় তথা ব্যাঘ্রমূর্তি। মন্ত্রপাঠ, নৈবেদ্য ইত্যাদি ধর্মীয় আচারাদির পাশাপাশি প্রসাদ ও শিরনি বিতরণ করা হয়। হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে মানুষ মনস্কামনা পূর্ণ করতে মানত করেন। ইচ্ছা পূরণ হলে পরবর্তী বছর পূজার দিনে মানত পূরণ করা হয়। পূজাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ মেলা বসে অনেক স্থানে।
বনবিবির কাহিনি শুধুই গল্প, না সত্য, তা নিয়ে বিভেদ আছে। তবে এই কাহিনির কিছু চরিত্র ইতিহাসে বর্তমান। আর এই ইতিহাসের উপাত্ত বনবিবির অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাসীদের আরও সংহত করেছে বলে মনে করেন ভক্তরা।
‘বনবিবির পাঁচালি’ বর্ণনা করতে গিয়ে মনোরঞ্জন মণ্ডল বলেন, অনেক বছর আগে সুন্দরবনের পাশের গ্রামের এক দরিদ্র মায়ের শিশু ছেলে দুঃখেকে সুন্দরবনে মধু আহরণ করতে নিয়ে যান ধনে আর মনে নামে দুই ব্যবসায়ী। দুঃখেকে মা বলেন, ‘বনে আমার মতো তোর আরেক মা আছেন। কোনো বিপদে পড়লে তাঁকে ডাকবি।’
তখন বনে গাজী নামে এক আউলিয়া থাকতেন। দক্ষিণ রায় বাঘবেশী অপশক্তি। গাজীর সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। এক রাতে রায়মণি বা দক্ষিণ রায় ধনে-মনেকে স্বপ্নে দেখা দেন। তিনি দুই ভাইকে প্রচুর মধু আর সম্পদ দেওয়ার লোভ দিয়ে দুঃখেকে উৎসর্গ করতে বলেন। অন্যথায় তাদের নৌকা ডুবে যাওয়ার এবং মধু না পাওয়ার ভয় দেখান। ধনে আর মনে ভয়ে দুঃখেকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাকে পানি আনতে পাঠিয়ে নৌকা ছেড়ে চলে যান। দুঃখে মায়ের কথামতো সেই মাকে স্মরণ করে। বনবিবি এসে দুঃখেকে বাঘরূপী দক্ষিণ রায়ের কবল থেকে উদ্ধার করেন এবং তাকে কুমিরের পিঠে ভাসিয়ে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন।
এদিকে বনবিবির ভাই শাহ জঙ্গালী বাঘরূপী দক্ষিণ রায় ও গাজী আউলিয়াকে ধরে বনবিবির কাছে নিয়ে যান। গাজী দক্ষিণ রায়ের সঙ্গ ছেড়ে বনবিবির পক্ষ নেন। এভাবেই পরবর্তী সময়ে বনবিবি সুন্দরবনজীবী মানুষের কাছে দেবীর মর্যাদা পেয়ে পূজিত হতে শুরু করেন।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে সুন্দরবন এলাকায় দক্ষিণ রায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বনবিবির জহুরানামা নামে একটি বই উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, বনবিবি বেরাহিম নামে এক আরবদেশির কন্যা। বেরাহিমের স্ত্রী গুলাল বিবি সতিনের প্ররোচনায় সুন্দরবনে পরিত্যক্ত হন। সেখানে তাঁর গর্ভে বনবিবি ও শাহ জাঙ্গুলী জন্ম নেন। দক্ষিণ রায় যশোরের ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীন ভাটির দেশের রাজা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বনবিবির একাধিক যুদ্ধ হয়। দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন।
ইতিহাসের সঙ্গে লোককথার যতই অসংগতি থাক, বনবিবি দক্ষিণাঞ্চলের হাজারো সুন্দরবনজীবীর মনে এখনো ভক্তি, শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের স্তম্ভ হয়ে আছেন।