দীর্ঘ ২৮ দিন পার হয়ে গেলেও বঙ্গোপসাগের মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ এফ.বি মুক্তি-১ নামের ট্রলারসহ ১৬ জেলের কোনো সন্ধান এখনও মেলেনি।
যতোই দিন যাচ্ছে, ততোই উৎকন্ঠা বাড়ছে স্বজনদের। কান্না আর আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে শরণখোলার আকাশ-বাতাস। ট্রলার মালিক ও স্বজনরা বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি করে করে এখন হতাশ হয়ে পড়েছেন।
জেলে নিখোঁজের খবর ইতোমধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রপত্রিকায় প্রচার-প্রকাশিত হলেও হতভাগ্য ওই সকল জেলেদের উদ্ধারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ পরিবারের।
জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলাকারী বাহিনীকে লিখিতভাবে অবহিত করা হলেও এ ব্যাপারে কারোর কোনো মাথাব্যাথা নেই। দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের। দেখছি দেখবো বলে যে যার দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম সাগর থেকে মাছ শিকার করে প্রতিবছর সরকারের কোষাগারে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব জমা দিলেও বিপদে-আপদে ওই সমস্ত জেলে ও মহাজনদের কোনো খোঁজ রাখেনা সরকার। এমন অভিযোগ নিখোঁজ জেলে পরিবার, মালিকপক্ষ ও স্থানীয় মৎস্যজীবীদের।
তারা কোস্টগাডর্, নৌবাহিনীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর, সুন্দরবন, ভারত, মায়ানমার ও থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে জেলেদের খুঁজে বের করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
গত শনিবার রাতে নিখোঁজ হওয়া জেলেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খোঁজখবর নিয়েছেন শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহম্মদ অতুল মন্ডল। এসময় কান্নায় ভেঙে পড়া স্বজনদের শান্তনা দিয়ে নিখোঁজদের উদ্ধারে সহযোগীতা করার আশ্বাস দেন তিনি।
পরে প্রত্যেক পরিবারকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল, ডাল, তেল, বিস্কুট ও নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করেন ইউএনও।
এদিকে, নিখোঁজ জেলেদের পুঁজি করে একটি প্রতারক চক্র অর্থ বাণিজ্যে নেমেছে বলে অভিযো উঠেছে।
শনিবার রাতে জাহিদ নামের এক ব্যক্তি পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার দৈনিক ভোরের কাগজের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ০১৭৯৭১৬২৭২৯ নম্বর থেকে শরণখোলার সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খোকনের কাছে কল করে জানান, তিনি নিখোজ হওয়া ফারুক খান ও মধু খান নামের দুই জেলেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধান করেছেন।
তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক জানিয়ে তিনি বলেন, দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই খবর শোনার পর ট্রলার মালিক বিলাশ রায় কালু সাংবাদিক পরিচয়ধারী ওই ব্যক্তির সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন এবং ওই ব্যক্তি দুই জেলের চিকিৎসা খরচবাবদ বিকাশের মাধ্যমে দুই বারে ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন।
সেই থেকে ওই প্রতারকের মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
গত ১০ ডিসেম্বর এফ.বি মুক্তি-১ (রেজি: নং- ৬৪২২) নামের ওই ট্রলারটি পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের বগী স্টেশন থেকে পাস গ্রহন করে ১১ ডিসেম্বর ভোররাতে ইলিশ আহরণের জন্য বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হয়। ট্রলারে মোট ১৬ জন জেলে (মাঝিমাল্লা) ছিলেন।
নির্ধারিত সময় ও পাসের মেয়াদ অনুযায়ী ট্রলারটি মাছ শিকার করে ১০-১২ দিনে মধ্যে সাগর থেকে ফিরে আসার কথা। কিন্তু অতিরিক্ত আরো ১৪-১৫ দিন অতিবাহিত হলেও ট্রলারটি ফিরে না আসায় মহাজন ও জেলে পরিবারে উৎকন্ঠা দানা বাঁধতে থাকে।
এ ঘটনায় শরণখোলা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ট্রলারটির মালিক পক্ষ।
নিখোঁজ জেলেরা হলেন- ট্রলার মাঝি মো: শাহআলম ফরাজী (শাহা মাঝি), জেলে ই্উনুচ হাওলাদার, তহিদুল হাওলাদার, শাহজাহান হাওলাদার, বারেক তালুকদার, হেমায়েত হাওলাদার, আলামীন মোল্লা, হালিম হাওলাদার, আব্দুলাহ খান, আব্বাস আকন, হাচান সিকদার, ফারুক খান, মধু খান, কামাল হাওলাদার, নাঈম হাওলাদার।
এদের সকলের বাড়ি শরণখোলা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। এছাড়া ট্রলারের মিস্ত্রি শামছুদ্দিন হাওলাদারের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী এলাকায়।
নিখোঁজ ট্রলারের মালিক বিলাশ রায় কালু বাগেহরাট ইনফো ডটকমকে জানান, ট্রলার নিখোঁজের বিষয়টি বিভিন্ন জেলে ও মহাজনদের কাছে জানানো হয়েছে। তাছাড়া সরকারের কাছে সহযোগীতা চেয়ে ইউএনও ও ডিসি বরাবরে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে।
প্রতিদিন জেলেদের স্ত্রী-সন্তান ও আত্মীয়স্বজনরা বাসায় এসে কান্নাকাটি করছে। তাদেরকে শান্তনা দেয়ার আর কোনো ভাষা তার জানা নেই। সরকারের সহযোগীতা ছাড়া নিখোঁজ জেলেদের উদ্ধার করা কোনোভাবেই সম্ভব না।
উপজেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আবুল হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মজিবর তালুকদার বাগেহরাট ইনফো ডটকমকে জানান, হয়তো ট্রলারটির ইঞ্জিন বিকল হয়ে ভাসতে ভাসতে ইন্ডিয়া বা মায়ানমার সীমান্তের দিকে চলে যেতে পারে। ডাকাতে নিলে অথবা কাছকাছি কোথাও থাকলে যে কোনোভাবে তার সন্ধান পাওয়া যেত। তারাও ট্রলারটি উদ্ধারে সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহম্মদ অতুল মন্ডল বাগেহরাট ইনফো ডটকমকে বলেন, নিখোঁজ জেলেদের পরিবারে শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্বজনরা কান্নাকাটি করছে। তাদের সন্ধানে প্রশাসনের উচ্চ মহলে যোগাযোগ চলছে। একটি প্রতারকচক্র নিখোঁজ ব্যক্তিদের পুঁজি করে অর্থ বাণিজ্যে নেমেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতারকদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।