মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-পথ ভরাটের পেছনে কারণ হিসাবে একটি মহল দায়ি করছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পোল্ডারকে। আর এ জন্য বন্ধ হয়েছে ওয়াপদ’র বাস্তবায়নাধীন ৩৪/২ পোল্ডারের সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কার্যক্রম।
এ অবস্থায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে ১৬৭ কোটি ২৬ লাখ টাকার এই প্রকল্পটি।
সূত্র জানায়, সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির পর থেকে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-পথ পুন:খনন ও চালুর দাবি জোরদার হয়। তখন থেকেই ওয়াপদার বিরুদ্ধে একটি মহলের (মন্ত্রনালয়) এই অভিযোগ ওঠে।
এ অবস্থায় চরম অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বাগেরহাটসহ এ অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রন ও লবণাক্ততা হ্রাসের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধিনে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পটি।
তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অভিমত কেবল মাত্র অনুমান নির্ভর সন্দেহে আটকে গেছে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের কাজ।
প্রকল্প কর্মকর্তা জুলফিকার আলী হাওলাদার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে মৌখিকভাবে নির্দেশের পর থেকে গত ২২ ডিসেম্বর থেকে বন্ধ রাখার হয়েছে প্রকল্পের এই পোল্ডারের (বাঁধে) কাজ।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৩৪/২ পোল্ডার প্রকল্প মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-পথ ভরাট হবার জন্য কোন ভাবেই দায়ি না। গত ২৮ বছর ধরে নিয়মিত খনন না করায় নৌ-পথটি ভরাট হয়েছে। বরং এই বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথের পলি ব্যবস্থাপনা সহজতর হবে।
অন্যদিকে, ৩৪/২ পোল্ডারের কার্যক্রম বন্ধ রাখায় প্রকল্প এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
তারা মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-পথের খনন কাজ সফল করতে রামপালের দাউদখালী নদী পুণ:খননসহ ৩৪/২ পোল্ডার বাস্তবায়ন কাজ দ্রুত চালু করার দাবি জানান।
৩৪/২ পোল্ডার প্রকল্পের পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস এর প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে বাগেরহাট ওয়াপদার একাধিক কর্মকর্তা বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানিয়েছেন, ঐ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে- পোল্ডার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন না হলেও প্রাকৃতিক কারণেই নৌপথটি ভরাট হবে। ৩৪/২ বাঁধ প্রকল্প বাংলাদেশের আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি পরিবেশবান্ধব ও ইতিবাচক সমাধান।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বাগেরহাট সদর উপজেলার অন্তর্গত যৌখালী উপ-প্রকল্প, ফকিরহাট উপজেলার মাসকাটা উপ-প্রকল্প এবং খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার আমিরপুর-ভান্ডারকোট উপ-প্রকল্পকে একত্রিত করে ৩৪/২ প্রকল্প তৈরী হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৫০ কি.মি. বাঁধ নির্মাণ ও ১১০ কি.মি. নদী-খাল পুণ:খননের কথা।
বাগেরহাট সদর ও রামপাল উপজেলার একটি বড় অংশ এবং মংলা ও ফকিরহাট উপজেলার কিছু এলাকা প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। তিন বছর মেয়াদী প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১২-১৩ অর্থ-বছরে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের শতকরা প্রায় এগারো ভাগ কাজ শেষ করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা।
বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের সুফল সম্পর্কে বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাইনদ্দীন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, রূপসা ও পশুর নদীর পূর্ব পাড়, মংলা ও কুমারখালী নদীর উত্তর পাড় এবং বিষ্ণু নদীর পশ্চিম পাড়ে খুলনা ও বাগেরহাট জেলার পাঁচটি উপজেলা এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত। প্রকল্প এলাকার আওতায় মরা পশুর, দাউদখালী, মইদাড়া ও ইছামতি নদীসহ ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ খাল পুণ:খনন করা হবে। যার অধিকাংশই মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-পথের সাথে সংযুক্ত।
এ সব নদী ও খাল খনন করে নিয়ন্ত্রক গেটগুলো কার্যকর করা গেলে এই নৌ-পথের নাব্যতা স্থিতিশীল থাকবে।
তিনি আরও বলেন, ৩৪/২ পোল্ডার বাস্তবায়ন হলে প্রায় ৪৮ হাজার হেক্টর জমি সমন্বিত বন্যা ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতায় আসবে। লবনপানি মুক্ত হবে প্রায় ত্রিশ হাজার হেক্টর জমি। অনাবাদী কৃষি জমি কমবে। সেচের আওতা বাড়বে শতকরা প্রায় ৬৮ ভাগ। প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার হেক্টর নীচু জমি মাঝারি উঁচু ও উঁচু জমিতে পরিণত হবে। প্রকল্প এলাকা থেকে বছরে প্রায় দুই হাজার ৩০০ মে. টন মাছ উৎপাদন হবে।
মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যনেল রক্ষা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অ্যাড. মহিউদ্দিন শেখ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘এলাকায় চিংড়ি ঘেরের সমর্থক শক্তিশালী একটি মহল ৩৪/২ পোল্ডার বাস্তবায়নে বাঁধা সৃষ্টি করে আসছেন। কিন্তু পোল্ডারটি রামপাল-মংলা এলাকার মানুষের জীবন জীবিকার জন্য একান্ত প্রয়োজন।
মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-পথের সাথে এই পোল্ডার প্রকল্প সাংঘর্ষিক না, বরং সহায়ক।’ তিনি অবিলম্বে এই প্রকল্পের কাজ শুরুর দাবি জানান।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-পথ যদি ওয়াপদার পোল্ডারের কারণে ভরাট হয় তবে ৩৫/১ পোল্ডারে বিছনা নদীর পূর্ব পাড়, মল্লিকের বেড় ও ডেমা এলাকায় এই নৌপথ সচল থাকছে কী ভাবে ?’
এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ও ওয়াপদা খুলনা জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জুলফিকার আলী হাওলাদার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘শেলা নদীতে ট্যাঙ্কার ডুবির পর মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-চ্যানেল ভরাট হবার জন্য যারা ওয়াপদার ৩৪/২ প্রকল্পকে দায়ী করছেন তারা সঠিক বলছেন না। অব্যাহত খনন ছাড়া ঐ নৌপথ সচল রাখা কঠিন। পোল্ডার ব্যবস্থা বাস্তবায়নের সাথে নৌ-পথটি ভরাট হবার কোন সম্পর্ক নেই। ভরাট হওয়া এলাকায় ওয়াপদার কোন পোল্ডার নেই।’
তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তি নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কাজ বন্ধ রাখবো। যদিও চলমান কাজ বন্ধ হলে প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত উন্নয়ন অংশিদাররা বড় ধরণের ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।’
এই পোল্ডার বাস্তবায়ন কাজ স্থগিত করা প্রসঙ্গে বাগেরহাট-৩ (রামপাল-মংলা) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি তালুকদার আব্দুল খালেক বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘৩৪/২ পোল্ডারের আওতায় দাউদখালী নদী, মরা পশুরসহ দুই শতাধিক রেকর্ডীয় খাল আছে। সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এগুলো খনন করা প্রয়োজন। তবে নির্বিঘ্নে দ্রুত মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথ খনন করা এখন সব থেকে জরুরী।’