সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে ছড়িয়ে পড়া তেলের প্রতিক্রিয়া পড়েছে প্রাণীকূলের উপর। কাঁকড়া, ছোট মাছ, গুইসাপের পর এবার ভোঁদড়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
গত বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনাস্থলের অদূরে শ্যালা নদীর আন্ধারমানিক এলাকা থেকে বন বিভাগের কর্মীরা দু’টি ভোঁদড়ের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোঁদড় দুটির ময়নাতদন্ত করে বন বিভাগ। এর মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হয়েছে যে, তেল মিশ্রিত পানি পানেই এগুলোর মৃত্যু হয়েছে।
এ পরিস্থিতিকে প্রাণিকুলের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এরই মধ্যে রবিবার থেকে জাতিসংঘ দল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে। শনিবার তারা মংলায় পৌঁছেছে।
সুন্দরবনের বন্য প্রাণী বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ওয়াইল্ড লাইফ) জাহিদুল কবির বলেন, ‘তেলের কারণে বন্য প্রাণীর ওপর যে ধরনের প্রতিক্রিয়া পড়বে বলে আমরা আশঙ্কা করেছিলাম, তা পড়েনি। তবে কিছু প্রাণী মারা গেছে। বৃহস্পতিবার আমরা দুটি মৃত ভোঁদড় পেয়েছি।’
‘ভোঁদড় দেশে মহাবিপন্ন প্রজাতির একটি প্রাণী’ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। একসময় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদীগুলোতে অসংখ্য ভোঁদড়ের দেখা মিলত। এখন শুধু সুন্দরবনেই এর দেখা মেলে। নড়াইল ও সুন্দরবনের জেলেরা ভোঁদড় দিয়ে বড় মাছ শিকার করেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকসহ বিশ্বের বিভিন্ন বন্য প্রাণিবিষয়ক সংস্থা ভোঁদড় নিয়ে গবেষণা করছে।
জাহিদুল কবির জানান, ময়নাতদন্ত করে দেখা গেছে, তেলমিশ্রিত পানি পানেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া কাঁকড়া, ছোট মাছ মরেছে। কিছু সাদা বকের শরীরে এবং কুমিরের গায়ে তেলের দাগ দেখা গেছে।’
তেলের প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে ঘটবে এমন নয়, প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারীও হতে পারে। আমরা দ্রুতগতিতে তেল সরিয়ে ফেলছি, এটি ভালো দিক। তবে গোটা পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে পর্যবেক্ষণ করা উচিত’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় এক লিটার পানিতে ৯ মিলিগ্রাম অক্সিজেনের উপস্থিতি থাকতে হয়। কিন্তু দূর্ঘটনার পর শ্যালা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ এখন গড়ে প্রতি লিটারে ৪ দশমিক ৯ মিলিগ্রাম, যা প্রাণিকুলের জন্য হুমকিস্বরূপ। অবশ্য মূল চ্যানেল অর্থাৎ পশুর নদীর পানিতে অক্সিজেন পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে ৭ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে এক দল শিক্ষার্থী গত ১৬ ডিসেম্বর দুর্ঘটনাস্থল সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেন। সেখান থেকে সংগৃহীত পানির নমুনা গবেষণাগারে পরীক্ষা করে তাঁরা এই ফল পেয়েছেন।
ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, ভারী হওয়ার কারণে অধিকাংশ তেল পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া জোয়ারের পানিতে নদীতীরবর্তী গুল্ম, শ্বাসমূল, গাছপালার কাণ্ড ও পাতায় তেল লেগে আছে। বন বিভাগ গুল্ম, শ্বাসমূল, গাছপালার কাণ্ড, পাতা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। শ্যালা নদীতে বাগদা চিংড়ির পোনা মারা গেছে, কাঁকড়া, ছোট পোকাও আর দেখা যাচ্ছে না। নদীতীরে হরিণও আসছে না।
বন বিভাগের পক্ষ থেকে এখনো তেল অপসারণ ও পরিচ্চ্ছন্নতা অভিযান চালানো হচ্ছে। তেল এখন কম পাওয়া গেলেও অভিযান চলছে। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, যত দিন তেল পাওয়া যাবে, তত দিন অপসারণকাজ চালবে। এখন আমরা নদীতীরের লতা-পাতা-গুল্মে জড়ানো তেল অপসারণের জন্য ওই সব লতা-গুল্ম-ছোট গাছ কেটে ফেলছি। সেগুলো সরিয়ে নিয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান ১২ ডিসেম্বর সুন্দরবনে যান। তিনি সেখানে মৃত প্রাণীর দেহ খায় এমন প্রজাতির পাখি, মাছ, ইগল, শঙ্খচিল, কালো চিল, চেনজিয়াবল সাদা ইগল ও শকুনের আনাগোনা দেখতে পান। শীতের এই সময়ে সাধারণত এসব পাখিকে পূর্ব সুন্দরবনে দেখা যায় না। মূলত এই পাখিদের প্রধান খাবার মৃত প্রাণীর দেহ।
মনিরুল খান এ ব্যাপারে জানান, ডিসেম্বরের শেষে এসে এই পাখিগুলো পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় থাকার কথা নয়। এর আগে এই সময়ে এদের এখানে দেখা যায়নি। মৃত অসংখ্য প্রাণীর দেহ আছে এমন খোঁজ ও ঘ্রাণ পেলেই এরা এ এলাকায় এসে হাজির হয়। এই ইগল, চিল ও শকুনদের দেখে মনে হচ্ছে, সুন্দরবনে অসংখ্য প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে।
শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজডুবির পর থেকে বন বিভাগের বন্য প্রাণী চিকিৎসক সৈয়দ আহমেদ ও মফিজুর রহমানের সমন্বয়ে ছয় সদস্যের একটি দল প্রতিদিন পূর্ব সুন্দরবন পরিদর্শন করছে। দলটি গতকাল সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকায় শরীরে তেলমাখা কুমির ও গুইসাপ দেখতে পেয়েছেন।
গত ৯ ডিসেম্বর ভোরে শ্যালা নদীর মৃগমারী এলাকায় তেলবাহী জাহাজডুবিতে সাড়ে তিন লাখ লিটারেরও বেশি ফার্নেস অয়েল সুন্দরবনের বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেলের দূষণে শ্বাসমূলীয় এই বনের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। পানির অণুজীবগুলো মারা গেছে এবং তা আর বিকশিত হতে পারছে না। এখন তারই প্রতিক্রিয়া পড়তে শুরু করেছে।