বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার এ বনের অন্যতম পরিচিতি ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
তবে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা কত তা সঠিক জানা না থাকলেও, ট্যাঙ্কার দুর্ঘটনার পর ছড়িয়ে পড়া তেলের পরিমাণ যে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ লিটার তা এখন সবারই জানা।
সরেজমিনে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের অন্তর্গত দুর্ঘটনা কবলিত শ্যালা নদীতে দীর্ঘক্ষণ ঘুরেও দেখা মেলেনি কোনো মাছ বা জলজ প্রাণীর। নদী তীরে দেখা যায়নি হরিণ কিংবা চোখে পড়েনি কোনো পরিযাই পাখিও।
শ্যালা নদীর দু’তীরে সবুজ বনে এখন কেবলই তেলের ছোপ ছোপ কালো দাগ।
মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) এ নদীর চাঁদপাই স্টেশন সংলগ্ন বাদামতলা এলাকায় ৩ লাখ ৫৭ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েলবাহী ওটি সাউর্দান স্টার-৭ নামে একটি ট্যাঙ্কার অপর আর একটি ট্যাঙ্কারের ধাক্কায় ডুবে যায়। যা ছড়িয়ে পড়ে বনের প্রায় ৩৪ হাজার হেক্টরেরও বেশি এলাকায় জুড়ে।
এসব এলকার নদী-খাল গুলোর দু’পাড়ের গাছের পাতা ও শ্বাসমূল এখনও ঢেকে আছে কালো তেলের আবারনে।
সরকারি সিদ্ধান্তে এ তেল কেনার খবরে সুন্দরবনের শ্যালা নদীর মৃগমারী খাল থেকে তেল সংগ্রহ করে নিয়ে ফেরা মংলার জয়মনি এলাকার জেলে আউল আলী ফকির (৩৫) বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আমরা যে খাল থেকে তেল তুলছি, সেখানে আরো অনেক তেল রয়েছে।
৩ ঘণ্টায় তিনি এবং তার দুই ছেলে মিলে ৮০ লিটারের মতো তেল তুলেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বনের গাছ এবং গাছের পাতা ও মূল তেলের কারণে কালো হয়ে গেছে।
চাঁদাপাই রেঞ্জের ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড বায়োডায়ভারসিটি কর্মকর্তা মেহেদি হাসন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, তেলের ফলে এখানের ক্ষতিটা দু’ ধরনের হতে পারে। সল্পমেয়াদে মাছ, কাঁকড়া, ডলফিন, কুমির ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নদী হয়ে ছোট ছোট খাল গুলোতে ছড়িয়ে গেছে এ তেল।
বনের ভেরের দিকটা সাধারণত একটু জলমগ্ন থাকে। পানির সঙ্গে এই তেল বনের ভেতরে চলে যেতে পারে। ফলে ছোট ছোট চারা গাছ, ঘাস ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এগুলো হরিণের প্রধান খাবার। যার প্রভাব পড়বে বাঘের উপর।
তিনি বলেন, কতটুকু ক্ষতি হবে তা আসলে এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। এর জন্য আরো গবেষণা ও দীর্ঘ মেয়াদি কাজ করা দরকার। আমাদের আগের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি হয়তো রয়েছে। তবে এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
এব্যাপারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার দত্ত বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, নদী সংলগ্ন এলাকায় এই ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় বনের যেসব গাছপালায় তেল লেগেছে, সেগুলোও অক্সিজেন না পেয়ে ধীরে ধীরে মারা যেতে পারে।
পখির পালকে এই তেল লাগলে সে গুলো আর উড়তে পারবে না। পালক ঝরে যাবে। নতুন করে আর পালক নাও গজাতে পারে।
মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরুক্ত সচিব মো. নুরুল কবির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, এ এলাকাটি (শ্যালা নদী) ডলফিনের অভয়াশ্রম। এখানে আগে থেকেই নৌযান চলাচল না করার সাজেশন ছিলো। মন্ত্রী (নৌ মন্ত্রী) আসছেন তারাও ফিজিক্যালি দেখছেন। নৌ পথ বন্ধের বিষয়টি সরকারি সিদ্ধান্তে ব্যাপার।
তদন্ত কমিটি এই নৌ রুটটি বন্ধের সুপারিশ করবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরিবেশ এবং বন বিভাগের পক্ষ থেকে আগেও সুপারিশ ছিলো এ পথটি ব্যবহার না করতে। ভবিষ্যতেও জাহাজ চলাচল না করার জন্য সুপারিশ থকবে।
দীর্ঘ মেয়াদে বনের ওপর তেলের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, প্রাথমিক ভাবে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই কিছু গাছ/ঘাস মারা যাবে। প্রকৃতিগত ভাবেই তা আর পূর্নঃজন্ম হবে। দীর্ঘ মেয়াদের ক্ষতি সম্পর্কে বলতে গেলে আরো গবেষণার দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মঙ্গলবার রাষ্ট্রায়ত্ব খুলনার পদ্মা অয়েল ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাওয়ার পথে সুন্দরবনে যাত্রাবিরতিকালে দুর্ঘটনায় পড়ে ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের ট্যাঙ্কার।
এমটি টোটাল নামে অপর একটি ট্যাঙ্কারের ধাক্কায় তেলবাহী ট্যাঙ্কারটির এক পাশ ফেটে যায় এবং শ্যালা নদীতে ডুবে তেল ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারটি উদ্ধার করা হয়।
এ দুর্ঘটনা বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী-শুশুক ডলফিন ও বনের প্রাণবৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলবে বলে ধারণা পরিবেশবিদ ও বন্য প্রাণী গবেষকদের।