সাড়ে ৩ লাখ লিটারেরও বেশি ফার্নেস অয়েল নিয়ে শ্যালা নদীতে নিয়ে ট্যাঙ্কার ডুবির পর পেরিয়ে গেছে চার দিন। এরই মধ্যে তেলের ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সুন্দরবনের প্রাণীবৈচিত্রে।
মারা যেতে শুরু করেছে ছোট ছোট মাছ, কাঁকড়া, গুইসাপসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। ভেঙে পড়ছে ইকোসিস্টেম (বাস্তুসংস্থান)।
শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) সুন্দরবনের ক্ষতির চিহ্ন বেশি চোখে পড়ছে। যতই সময় গড়াচ্ছে, উত্তরোত্তর ক্ষতির আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও বন কর্মকর্তারা মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) শ্যালা নদীতে ট্যাঙ্কার ডুবির পর থেকেই সুন্দরবনে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছিলেন।
বনবিভাগ সূত্র মতে, সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের শ্যালা নদী এবং আশপাশের প্রায় ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকা জুড়ে ছড়িয়েছে এ তেল। যার মধ্যে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিনের অভয়াশ্রমও।
বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী এবং সংলগ্ন লোকালয়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে ফার্নেস অয়েলবাহী ট্যাঙ্কারটি উদ্ধার হলেও এরই মধ্যে এ তেল ছড়িয়ে পড়েছে বন এবং বনসংলগ্ন এলাকাগুলোতে।
ইতোমধ্যে বন ও বনসংলগ্ন এলাকার বাস্তুসংস্থানের (ইকোসিস্টেম) ওপর তেলের ক্ষতিকর প্রভাব শুরু হয়ে গেছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
ফার্নেস অয়েলের ক্ষতিকর প্রভাবে বনের ভেতরে বিভিন্ন এলাকায় মরে যেতে শুরু করেছে মাছ, কাঁকড়াসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী। কুকড়ে যাচ্ছে গাছের পাতা। অভয়ারণ্যে দেখা মিলছে না ইরাবতি ও শুশুক-ডলফিনের।
সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ফরেস্ট রেঞ্জার ও কুমির বিশেষজ্ঞ আব্দুর রব বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, মঙ্গলবার দুপুরে সুন্দরবনের পশুর নদীতে জোয়ারের পানি আসলে লবণ পানির কুমিরের চৌবাচ্চাগুলোর পানি পরিবর্তন করা হয়। এরপর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লবণ পানির সাতটি ছানার মুখে ঘা দেখা দিয়েছে।
আগস্ট মাসে এ কুমির প্রজনন কেন্দ্রে পিলপিল ও জুলিয়েট এ সাতটি নতুন বাচ্চা জন্ম নেয়। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি জানান, লবণ পানির কুমিরের চৌবাচ্চায় প্রতিদিনই পানি পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। কিন্তু নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় আপাতত চৌবাচ্চার পানি পরিবর্তন বন্ধ রাখা হয়েছে। পানি পরিবর্তন করতে না পারার ফলে এই কুমির ছানাগুলোকে মলমূত্রের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। এই অবস্থা যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে লবণ পানির কুমির ছানা অন্যত্র সরিয়ে নিতে হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
তিনি আরও বলেন, সুন্দরবনের শ্যালা ও পশুর নদীর মোট ৩১ কিলোমিটার এলাকা ডলফিনের অভয়ারণ্য। এর মধ্যে যে স্থানে তেলের ট্যাঙ্কার ডুবির ঘটনা ঘটেছে সেইস্থান এবং পশুর নদীর কোল ঘেঁষে যে স্থানে করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে সেই স্থানে ডলফিনের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র।
বিরামহীনভাবে এখানে ডলফিন (উঠানামা) লাফাতে থাকে। এসব স্থানে ডলফিন দেখতে পর্যটকরা ভিড় করে থাকেন। কিন্তু বুধবার ও বৃহস্পতিবার একটি ডলফিনও লাফাতে দেখা যায়নি। এসব জলজ প্রাণী বেঁচে থাকবে না স্থান পরিবর্তন করবে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশের শ্বাসমূলীয় এ বনে গাছের শ্বাসমুখে গাড়-ঘন তেলের প্রলেপ জমে রয়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকার নদী খাল জুড়ে এখন শুধু তেল আর তেল। বাতাসে তেলের গন্ধ। তেলের প্রলেপের কারণে মাছ ধরতে পারছেন না জেলেরা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, জোয়ারের নোনা পানি পুরো বনাঞ্চল ছড়িয়ে পড়বে। আর বনের গাছগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গাছগুলোর চারপাশে শ্বাসমূল থাকবে। জোয়ারের সময় এ শ্বাসমূল পানিতে ভেসে থাকবে। আবার ভাটার সময় তা মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। মূলের মাধ্যমে শ্বাস নেয় এ ধরনের বনের গাছপালা।
ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ায় শ্বাসমূলগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া পানিতে মিশে এ তেল পানির অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দিচ্ছে। জলজপ্রাণীরা অক্সিজেনের জন্য ভেসে উঠে পানির উপরের দিকে। কিন্তু তেলের প্রলেপ পড়ায় শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে তাদের।
তাছাড়া বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে থাকা সুন্দরবনের শ্যালা নদী সংলগ্ন লোকালয়ের মানুষও এখন আর ব্যবহার করতে পারেছেন না এ পানি। বনের ভেতরে গাছপালাতেও পড়েছে এর প্রভাব।
শুক্রবার সকাল থেকে স্থানীয় অধিবাসী এবং জেলেদের দিয়ে তেল উত্তোলন শুরু হলেও ছড়িয়ে পড়া তেলের তুলনায় এ প্রচেষ্টা অতি নগণ্য।
রাষ্টীয় প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েলের ঠিকাদার আবদুল্লাহ ট্রেডার্সের মালিক রফিকুল ইসলাম বাবুল বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতি লিটার ৩০ টাকা দরে স্থানীয়দের কাছ থেকে ৫ হাজার ২০০ লিটার (২৬ ব্যারেল) তেল কেনা হয়েছে।
জেলেরা জানান, সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে তেলের প্রভাবে মাছ মরে ভেসে উঠছে।
সুন্দরবনের মৃঘামারী খাল থেকে ফিরে আসা স্থানীয় জেলে সোহাগ হাওলাদার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, ‘অনেক কাঁকড়া মরে ভেসে উঠছে। যেসব কাঁকড়া আমরা ধরছি সেগুলোর গায়েও তেল লেগে রয়েছে। কাঁকড়া ধরে নিয়ে বাসায় রাখার কিছুক্ষণ পরই সেগুলো মারা যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৩-৪টি কাঁকড়া ধরেছি। অন্য সময়ের তুলনায় এখন কাঁকড়া অনেক কম ধরতে পারছি। বনবিভাগে ২০০ টাকা দিয়ে কাঁকড়া ধরতে এসেছি। এ টাকাও এখন উঠছে না।’
জয়মনির ঘোল এলকার আব্দুলাহ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, আগে নদীতে মাছ, ডলফিন, শুশুক ভেসে উঠে অক্সিজেন নিত। তেল ছড়িয়ে পড়ার পর এখন নদীতে সেগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। আমরা মাছ পাচ্ছিনা। খালের ভেতরে ছোট ছোট মাছ মরে রয়েছে।
জেলে আনোয়ার হোসেন বলেন, স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে প্রতিদিন মাছ ধরতে নদীতে যাই। কিন্তু দুর্ঘটনার পর মাছের দেখা নেই। মাছ পাইনা।
নদীতে নৌকা নিয়ে ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহ করতে আসা জেলে জগদীশ ও শিশির রায় জানান, ‘নদীতে মাছ পাচ্ছি না, তাই তেল সংগ্রহ করে কিছু টাকা আয় করার চেষ্টা করছি।’
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের চাঁদপাই ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘তেলের কারণে নদী ও বনে প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমরা বিষয়গুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছি।’
ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহ করতে বনবিভাগের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে।