পূর্ব সুন্দরবন ঘুরে এসে: সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ওটি স্টার-৭ ডুবির পর থেকে অভয়আশ্রম পূর্ব সুন্দরবনে দেখা মিলছেনা ডলফিন-এর।
২০১১ সালে ডলফিনের অভয়াশ্রম হিসেবে বনের শ্যালা নদী সংলগ্ন চাঁদপাই, দুধমুখী ও ধানমারী এলাকাকে সরকারিভাবে ঘোষনা করা হয়।
কিন্তু তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির পর সুন্দরবনের এ নদীর বিস্তুণ এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি হুমকিতে পড়েছে বিশ্বে ইরাবতী ডলফিনের (যা শুশুক নামে পরিচিত) সবচেয়ে বড় এই বিচরণ ক্ষেত্র।
সরেজমিনে সুন্দরবনেরে শ্যালা নদী ও সংলগ্ন কয়েটি এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয় জেলে ও ট্রলার চালকাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন এ অভয়াশ্রম ছাড়াও পুরো পূর্ব সুন্দরবন জুড়ে বিস্তৃত নদী-খালে চরে বেড়ায় ডলফিন।
কিন্তু দূর্ঘটনার পর কালো ঝাজালো তেলে ছড়িয়ে পড়ায় এবং পানির উপর কালো আস্তরনে ঠেকে যাওয়ায় দেখা মিলছেনা ডলফিনের।
বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তারা জানিয়েছেন, প্রতিদিন কিছু সময় পর পরই পানিতে ভেঁসে ওঠে ডলফিন (স্থানীয় ভাবে ঠোষ/শুশুক নামে পরিচিত)। কিন্তু তেল ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে একটি ডলফিনও জাগতে দেখে নি তারা।
অপার প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের লীলাভূমি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। জীববৈচিত্রে ভরপূর নোনা পানির এ শ্বাসমূলীয় বনের মোট আয়তনের প্রায় ৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার বাংলাদেশে।
এ বনের মাঝে জালের মত ছড়িয়ে আছে প্রায় ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল। জলভাগে এর পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার।
বিশ্বে সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রভ বনের রয়েছে ডলফিনের তিনটি অভয় আশ্রম। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগরে চাঁদপাই রেঞ্জের অন্তরগত এই অভয় আশ্রমের কাছেই মঙ্গলবার ভোরে সাড়ে ৩ লাখ লিটারেরও বেশি জ্বালানী (ফার্ণেস অয়েল) তেল নিয়ে ডুবে গেছে একটি ট্যাঙ্কার।
চাঁদপাই রেঞ্জের শ্যালা নদীর মৃগোমারী ও তাম্বুল বুনিয়ার মাঝামাঝি এলকায় ‘ওটি সাউদার্ণ স্টার-৭” নামে ট্যাঙ্কারটি এমটি টোটাল নামে ওপর আর একটি ট্যাঙ্কারের ধাক্কায় ডুবে যায়। ট্যাঙ্কারটি খুলনার পদ্মা ওয়েল ডিপো থেকে জ্বালনি হিসাবে এই তেল নিয়ে গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্যেশে যাচ্ছিল।
এঘনায় নিখোঁজ রয়েছে তেলবাহী ট্যাঙ্কারটির মাস্টার মোকলেস (৫০)।
চাঁদপাই রেঞ্জের কাছেই শেলা নদীতে এ দুর্ঘটনা পর তিন দিনে তেলবাহী ট্যাংকার থেকে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ছে সুন্দরবনের প্রায় ৭০ কিলোমিটারও বেশি এলকার নদী-খালে।
বনবিভাগের ট্রলার চালক সামছুল আলম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, আমি ১২ বছর হলো এই বনে ট্রলার চালাই। প্রতি মূহুর্তে ডলফিন দেখি। আজ এই দূর্ঘটনার পর বন কর্তাদের নিয়ে প্রায় ৫ দফা শ্যালা নদী এবং সংলাগ্ন সুন্দরবনের আন্ধারমানিক, মৃগমারী, বেলতলা, জয়মনির, নন্দবালাসহ বেশ কয়েটি এলাক ঘুরলেও একটি ডলফিনও জাগতে দেখিনি।
বনবিভাগ ও ডলফিন সংরক্ষণ নিয়ে গবেষকরা মনে করছেন, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে এই দুর্ঘটনার পর তেল ছড়িয়ে পড়াতে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। আর এত অন্য জলজ প্রাণীর সাথে মারাত্মক অক্সিজেন সঙ্কটে পড়েছে ডলফিন।
ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (WCT) এডুকেশন ও রিচার্জ কো-অর্ডিনেটর ফারহানা আক্তার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, সুন্দরবনের এই এলকায় ইরাবতী ছাড়া ইন্দো-প্যাসেফিক হাম্প ব্যাক্ট ডলফিন, ফিনলেজ ডলফিন, ইন্দো-প্যাসেফিক বটল নোস ডলফিন, স্পিনার ডলফিন, পরপয়েজ ডলফিন, স্পটেড ডলফিন, গেংগেজ রিভার ডলফিন ছাড়াও ব্রাইডস হোয়েস নামে এক প্রজাতির তিমি বিচরণ করে।
তিনি বলেন, ডলফিন গোত্রের এই প্রাণী গুলোর বৈশিষ্ট্য হল প্রতি ২০ থেকে ২৫ মিনিট পর শ্বাস নেওয়ার জন্য পানির নিচ থেকে উপরে ভেসে উঠে। তেলবাহী ট্যঙ্কাার ডুবির ফলে মবিলের মতো ঘন এই তেলে পানির উপরের স্তরে কালো আবরন তৈরি করেছে। এর ফলে এসব প্রাণীর শ্বাস নিতে (অক্সিজেন গ্রহন) সমস্যা তৈরি হবার কথা।
তিনি শঙ্কা প্রাকাশ করে বলেন, সুন্দরবনের জনজ জীববৈচিত্র এবং ডলফিনের জন্য এ দূর্ঘটনা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পালে।
এবিষয়ে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) আবুল কালাম আজাদের সাথে ঘটনা স্থালের কাছে বসে কথা হয় বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে।
এসয় তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, শুধু ডলফিন নয়, শ্বাসমূলীয় সুন্দরবনের গাছপালা ও জলজ সম্পদের দির্ঘ্য মেয়াদি মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এ দূর্ঘটনার ফলে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আমীর হোসেন চৌধুরি বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, এধরনের ম্যানগ্রভ বনের গাছপালা অক্সিজেন গ্রহনে জন্য শ্বাসমূল ব্যবহার করে। এই তেল জোয়ারের সময় ছড়িয়ে পাড়ার ফলে গাছের শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহনে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে।
বনবিভাগ সূত্র জানায়, সুন্দরবনে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, গরান, গোলপাতাসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিট। বন্যপ্রাণীর বৃহত্তম আবাসস্থল সুন্দরবনে বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল-মায়া হরিণ, লোনা পানির কুমির, অজগর, কচ্ছপ, বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বাস করে এখানে।
এরমধ্যে ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরিসৃপ, আট প্রজাতির উভচর ও ৩০০ প্রজাতির পাখি রয়েছে।
১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেসকো কমিশন সুন্দরবনের কটকা-কচিখালী, নীলকমল, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ-মান্দারবাড়ীয়া সমুদ্র সৈকত এ তিনটি জোনের এক লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর এলাকাকে পৃথিবীর ৫৫২ তম বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ড হেরিটেজ) হিসেবে ঘোষণা করে।