সুন্দরবনের শ্যালা নদী থেকে ফিরে : ‘তহন আমরা বুহুত চিল্লাইছি, বাঁচাও বাঁবাও করছি। বয়া ফেলাও, বয়া ফেলাও (লাইফ জ্যাকেট), দুইডা বয়া ফেলায়ে দেও কইছি।’
‘পাসান ওরা কেউই পাসে আসেনি (ধাক্কা দেওয়া ট্যাঙ্কার এমটি টোটালের স্টাফরা)। এর মদ্দি (মধ্যে) দেখলাম ওরা তো কোন কথা হুনতে (শুনতে) ছেনাই না। তহন ভাবলাম আরো যদি ওগো কাছে যাই, তালে (তাহলে) বাউড়াইয়া মাইরা ফ্যালতে (পিটিয়ে মেরে ফেলতে) পারে।’
হনত ভাসতে ভাসতে কিনারের দিকি ছুটলাম। যখন ছুটি তহনও আমি মাস্টারকে দেখি মাথা জাগনা আছে। এর ফর (পর) কি-দে-কি আইছে (কি হয়েছে) তার আর আমি বলতি পারব না।
বিষ্ময় হয়ে অশ্রুসিক্ত মলিন মুখে মঙ্গলবার সন্ধায় দূর্ঘটনা কবলিত ট্যাঙ্কারে পাসে নদীতে একটি ছোট ট্রলারে বসে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে কথা গুলো বলছিলেন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ লিটার তেল নিয়ে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কার ‘ওটি সাউদার্ণ স্টার-৭’ এর সাপার ভাইজার মো. অলিউল্লাহ (৪৮)।
খানিকটা থেমে তিনি বলেন, আমরা স্টাফ হইলগে সাত জন। সাত জনই সামনের দিকে ছিলো। যহন ওইডে (ধাক্কা দেওয়া ট্যাঙ্কার) দেহা যাচ্ছে যে, আমাগো দিকি ইউঠে আসতেছে তহত ৪ জন দোড়োয়ে পেছনের দিকে চইলে আসে। আমরা আর (৩ জন) সারতি পারিনি।
যে দিস্টা (ট্যাঙ্কারের যে অংশে) মরছে, আমরা তার সমনে পইড়া গেছি। পেছনে গেলিও ৪ জনের এক জন আর ধরি থকতি পারিনি। সেও পড়ি যায়।
এমটি টোটালের ধাক্কয় মুহুর্তে ওটি সাউদার্ণ স্টার-৭ ডুবে যায় জানিতে অলিউল্লাহ বলেন, ধাক্কা দিয়ে উপরদে উঠে যাওয়ার সাথে যে জাহাজডা ডুইবে গ্যাছে পানিতে। ওই সময়ই আমাগে পানিতে টাইনে (স্রোরােতের টানে) নিয়ে গেছে।
ওই টাইনগে (টেনে) নেবার সমায় আমার মাজায় আর বুহে (বুকে) বাড়ি (আঘাত) লাগে। তহন ডুইবা যাই। পরে যহন উঠি (পানির উপর ভেসে উঠি) মাস্টার (নিখোঁজ মোকলেস) তহন আমার পেছনেই ছিলো।
তখন নয়নও (ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারের লস্কর) আমাগো আর একট্টু পিছোনেই ছিলো। তার পাসে পিছনে ছিলো বাবুচ্চি।
এভাবেই মঙ্গলবার কুয়াশাচ্ছন ভোরে সুন্দরবনের মাঝে তেলব্যাহী ট্যাঙ্কার ডুবির ভিবিষিখাময় মুহুর্তের কথা বাগেরহাট ইনফো ডটকম-এর কাছে তুলে ধরেন বেঁচে যাওয়া পটুয়াখালীর বাউফল এলাকার মো. অলিউল্লাহ।
ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারের বেঁচে যাওয়া অন্য ৫ জন হলেন, খুলনার রাজাপুর এলকার ইঞ্জিন চালক আবুল কালাম (৪৭), ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার চালক এবাদত সুবাফিন (৪৭), মাগুরার মুহাম্মদপুর এলাকার বাবুর্চি মো. আব্দুস্ সামাদ (২৬), ফরিপুরের কামার গ্রামের ট্যাঙ্কারটির লস্কর শওকত শেখ (৫০), বরিশালের রাজাপুর এলকার লস্কর মো. নয়ন।
বাবুর্চি মো. আব্দুস্ সামাদ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, ভাসতে ভাসতে প্রায় এক কিলোমিটার দুরে এটি ডালের সাথে বেধে যাই। পর ওই ডালটি শক্ত করে ধরি এবং অনেক কষ্টে তা বেয়ে তীরে উঠি।
লস্কর নয়ন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, নদীতে ভাসাতে ভাসতে সারা গায়ে (শরীরে) তেল মেখে যায়। গন্ধে শ্বাস নিতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে তীরে উঠে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
সাপার ভাইজার মো. অলিউল্লাহ জানান, এক এক জন এক এক যায়গায় উঠি। তখন নদীতে কোন ট্রলান বা নৌকাও ছিলনা। পরে একটা ছোট মাছ ধারা ডিঙি নৌকার মাঝি আমাদের দেখে তীরে আসে।
এর পর সবাই ওই নৌকায় এক যায়গায় হই। কিন্তু তখন আমাদের সহকর্মী মোকলেস মাস্টারকে আর খুজে পাইনি।
সকল ১০টার দিকে যখন পুলিশ আসে তখন ব্যাথার জন্য আমি নড়তে পাতেছিলাম না। পরে তারা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় এবং ইনজেকশন দেয়। এর পর ফিরে এসে আমরা সবাই এই ছোট নৌকায় এখানেই আছি।
ডুবন্ত আমাদরে ট্যাঙ্কারটি পাহারা দিচ্ছি আর সহকমীকে খুঁজছি। জানিনা তাকে পাব-কি না।
‘আপনাদের সাথে এই যে কথা বলছি এইটাই আল্লাহ এর কাছে শোকর।’
বাড়ির লোকজন এ ঘটনা জেনেছে কিনা এমন প্রশ্ন করলে সবাই জানান, ফোনে ফোনে সাবই জানছে। এজনের ফোন ভালো ছিলা তা দিয়েই মালিক এবং বাড়ি কথা বলছি।
বাড়ি যাবেন কখন এম প্রশ্নে কিছুটা থেমে ইঞ্জিন চালক আবুল কালাম বলেন, মালিকে এত বড় সম্পদ রেখে কি ভাবে যাই।
তীব্র শীতে নদীর মাঝে এভে আর কথক্ষন এখানে থাকবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের মালিক পক্ষ থেকে লোক এসেছিলো। তারা আরো দুটো ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়া ট্যাঙ্কারটি উদ্ধারে পাঠচ্ছে বলে জানিয়েছে।
তাই আমরা এখানে অপেক্ষায় আছি। যতক্ষন তার না আসবে আমরা এখানে থাকব।
ঘন কুয়াশার মাঝে চলতে গিয়ে যেন কোন দূর্ঘটনা না ঘটে সে জন্য আমরা তো নদীর এক পাসে নোঙ্গেড় করে ছিলাম। আমাদের কি দোস? তারা আমাদের মেরে দিয়ে চলে গেল?
বেঁচে যাওয়া ওই ৬ জনের অভিযোগ, ধাক্কা দেওয়া ট্যাঙ্কারটি যদি নিষ্ঠুরের মতো পলিয়ে চলে না গিয়ে আমাদের বাঁচাতে একটু চেষ্ঠা করত তবে মাস্টারকে হারাতে হত না।