ভাল নেই বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানী শিল্প ‘সাদা সোনা’ খ্যাত চিংড়ির প্রান্তিক উৎপাদকরা। একদিকে অব্যহত মূল্য হ্রাস, তার উপর চাষীদের বাগদা চিংড়ি বিক্রি করতে হচ্ছে বাকিতে।
গত তিন মাস ধরে স্থানীয় বাজারে অস্বাভাবিক ভাবে কমেছে বাগদা চিংড়ির দাম। প্রতিকেজি বাগদা’র দাম চারশ থেকে পাঁচশ টাকা পর্যন্ত কমেছে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন চাষিরা।
অন্যদিকে বাজারে দাম কমার সাথে সাথে ডিপো মালিকরা চাষীদের কাছ থেকে নগত টাকায় বাগদা চিংড়ি কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে সাদা সোনা খ্যাত দেশের দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলের কয়েক লক্ষ চিংড়ি চাষী এখন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। দিশেহারা চাষীরা এখন ভাবছেন বাগদা চিংড়ি চাষ থেকে সরে আসতে।
তবে, বাগতা চিংড়ির অস্বাভাবিক মূল্য হ্রাসের ব্যাপারে বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক এসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) দাবি আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা হ্রাস এবং বাগদা চিংড়ির দাম কমে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে, তাদের এ বক্তব্যে সন্তুষ্ট হয় সাধারণ চিংড়ি চাষিরা।
দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানী খাত এবং সম্ভাবনাময় চিংড়ি শিল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বাগেরহাট ইনফো ডটকম এর বিশেষ অনুসন্ধানে উঠে এসছে এসব কথা।
সরেজমিন বাজার ঘুরে এবং চিংড়ি চাষীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত আড়াই থেকে তিন মাসে গ্রেড (আকৃতি/সাইজ) ভেদে প্রতি কেজি বাগদা চিংড়ির দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত কমে যাওয়ার পেছনে বিএফএফইএ এর দাবি বাগদা চিংড়ির শিপমেন্ট বন্ধ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেছে।
কিন্তু চাষীদের প্রশ্ন এমন অজুহাতে মাছ কম্পানী আর আড়ৎদারদের তো চিংড়ি কেনা বন্ধ রাখার কথা? তবে, রপ্তানী বা শিপমেন্ট করতে না পরলেও তারা বাকিতে চিংড়ি কিনছেন কেন?
দেশের অন্যতম চিংড়ি প্রধান অঞ্চল বাগেরহাট জেলার বারাকপুর মৎস্য আড়ৎতের ডিপো মালিক ও চাষীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বাগেরহাট ইনফো ডটকম-এর। তারা জনাান, আন্তর্জাতিক বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম ও চাহিদা কমে যাওয়ায় অযুহাতে গত আড়াই থেকে তিন মাস ধরে চিংড়ির দাম কমিয়ে দিয়েছে করখানা মালিকরা। ফলে কম দামে চিংড়ি কিনছে ডিপো মালিকরা।
অন্যদিকে, কম দামে চিংড়ি বিক্রী করলেও নগদ অর্থ পাচ্ছেন না চাষীরা। ডিপো মালিকরা বলছেন, মাছ কম্পানি গুলো নগদ টাকায় চিংড়ি কিনছেনা। তাই দ্রুত পচনশীল এই মাছ বাধ্য হয়ে বাকিতে বিক্রি করছে মাছ কম্পানি গুলোর কাছে। ফলে চাষীদের মূল্য পরিশোদ করতে পাছেনা তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি মৌসুমের শুরুতে ১৫ গ্রেড যে বাগদা চিংড়ির বাজার দর ছিল ১৩শ’ থেকে ১৪শ’ টাকা তা এখন কমে দাড়িয়েছে সাড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। এই ভাবে ২০ গ্রেড বাগদা চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা যা আগে ছিল ১২০০ টাকা, ৩০ গ্রেড ৬০০ টাকা যা আগে ছিল ৮৫০-৯০০ টাকা, ৪৪ গ্রেড ৪০০ টাকা যা আগে ছিল ৬০০ টাকা এবং ৬৬ গ্রেড ২০০ টাকা যা আগে ছিল ৪৫০ টাকা।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বারাকপুর মৎস্য আড়তে বাগদা চিংড়ি বিক্রি করতে আসা বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার উজলকুড় ইউনিয়নের বড় দূর্গাপুর গ্রামের চিংড়ি চাষী দিপঙ্কর বাড়ৈ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, চলতি মৌসুমে ১৩ বিঘা জমিতে বাগদা চিংড়ির চাষ করেন তিনি। মৌসুমের শুরুতে ঘেরে রেণু পোনা ছেড়ে ভাইরাসের কারনে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।
পরে আবার নতুন করে পোনা দিয়ে চাষ শুরু করে বাগদা’র ভালো উৎপাদন পান। প্রথম দিকে বারো’শ টাকা পর্যন্ত কেজি বিক্রি করলেও বর্তমানে সেই একই চিংড়ি ৬ থেকে ৭শ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বাগেরহাট ইনফোকে তিনি বলেন, ‘ডিপো মালিকের কাছে বর্তমানে আমার প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকা পাওনা রয়েছে। এই টাকা কবে নাগাদ পাব তা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।’
সদর উপজেলার বাদখালি বিল এলকার শেখ বাসারাত হোসেন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ওঠানামা করবে। তবে তা হটাৎ করে এভাবে পড়ে যেতে পারেনা। বিষয়টি তদারকি করতে তিনি মৎস্য বিভাগের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
উপজেলার ডেমা গ্রামের চিংড়ি চাষী আব্দুস সাত্তার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, এবছর আমি কুড়ি বিঘা জমিতে বাগদা চিংড়ির চাষ করেছি। মৌসুমের শুরুতে বাগদা চিংড়ি নগদ টাকায় ভাল দাম পেয়েছি। কিন্তু গত তিন মাস ধরে বাগদা চিংড়ির দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বারাকপুর মৎস্য আড়ৎ এর শাহ জালাল মৎস্য আড়ৎ নামের একটি ডিপোতেই তার বর্তমানে প্রায় তিন লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। গত তিন মাস ধরে বাকিতে বাগদা চিংড়ি বিক্রি করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনিও কবে এ টাকা পাবেন তা নিয়ে এখন সন্ধিয়ান বলে জানান।
আব্দুস সাত্তার বাগেরহাট ইনফোকে বলেন, আন্তজার্তিক বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম কমে যাওয়ায় এবং নতুন করে বাগদা চিংড়ির কোন শিপমেন্ট না থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে ডিপো মালিকরা তাদের জানিয়েছে।
বারাকপুর মৎস্য আড়ৎ এর শাহ জালাল ডিপোর মালিক ইউসুফ হোসেন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক এসাসিয়েশন (বিএফএফইএ) দাবি করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম ও চাহিদা কমে যাওয়ায় বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম কমে গেছে। গত সেপ্টম্বর থেকে নতুন করে কোন শিপ মেন্ট হচ্ছেনা।
গত তিন মাসে আমি চাষীদের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকার বাগদা চিংড়ি বাকিতে কিনেছি। আমি যেমন চাষীদের কাছ থেকে বাকিতে চিংড়ি কিনেছি তেমনি আমিও এজেন্টের কাছে বাকিকে চিংড়ি বিক্রি করেছি। তারা আমার পাওনা টাকা না দেওয়ায় আমিও চাষীদের পাওনা পরিষদ করতে পারছি না।
চিংড়ি শিল্পকে রক্ষা করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিষয়টি এখনই গুরুত্বের সঙ্গে দেখার অনুরোধ জানান তিনি।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষী সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, চিংড়ি উৎপাদনে দেশের অন্যতম জেলা বাগেরহাট। এই জেলার শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত।
বিভিন্ন সময় চিংড়ি ঘেরে ভাইরাসসহ নানা প্রতিকূলতার মাঝে এগিয়ে এ খাতের উদ্যোগতারা (চাষীরা) এগিয়ে নিচ্ছিল চিংড়ি চাষ। চলতি বছরে শুরুতেও চিংড়ি ঘেরে ভাইরাস সংক্রমিত হয়। ঘের মালিকরা ভাইরাসের প্রকোপ কাটিয়ে উঠে ঘেরে চিংড়ির উৎপাদন ভাল পায়।
মৌসুমের প্রথম দিকে বাজারে আশানুরুপ দাম পেলেও, গত তিন মাস ধরে হঠাৎ করে স্থানীয় বাজারে বাগদা চিংড়ির দাম অস্বাভাবিকহারে কমে যায়। একদিকে চিংড়ির দাম কম অন্যদিকে তা আবার ডিপো মালিকদের কাছে বাকি রাখতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে চাষীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
এই অবস্থার নিরসন করা না গেলে চাষীরা চিংড়ির চাষের উপর আগ্রহ হারাবে বলে মন্তব্য করে চিংড়ি চাষী সমিতির এই নেতা সরকারকে বাইরের নতুন নতুন চিংড়ির বাজার সৃষ্টি করার দাবি জানান তিনি।
সমিতির অপর এক নেতা অবশ্য অতি মূনাভা লোভী কিছু চিংড়ি আড়ৎদার এবং ব্যবসায়ীর জন্য চিংড়ি রপ্তানী এখন হুমকিতে বলে মন্তব্য করেন।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য বিভাগের (ভারপ্রাপ্ত) বিভাগীয় মৎস্য কর্মকর্তা নারায়ণ চন্দ্র মন্ডল বাগদা চিংড়ির দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, হিসেব অনুযায়ী এ বছর জেলার নয়টি উপজেলায় মোট সত্তর হাজার হেক্টর জমিতে বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাষ হয়েছে।
এরমধ্যে ৪৭ হাজার হেক্টর জমিতে মোট ৩৯ হাজার ঘেরে বাগদা চিংড়ির চাষ করা হয়েছে। জেলায় বাগদা চিংড়ির বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ২৭১ মেট্রিক টন। মৌসুমের শুরুতে কিছুটা সমস্যা ছিল। এবছর বাগদা উৎপাদন ভাল।
তিনি জানান, বাগদা ও গলদা চিংড়ি উৎপাদনে দেশের অন্যতম জেলা বাগেরহাট। আর সারা দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৭০-৭৫ ভাগ হয় উপকূলীয় বাগেরহাট, খুলনা এবং সাতক্ষীরা জেলায়। প্রথম দিকে চাষীরা মাছের দামও ভাল পেয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে চিংড়ির বাজার দর পড়ে যাওয়ায় চাষীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
তবে, বাগদা চিংড়ির আকস্মিক এ দর পড়ে যাবার ব্যাপারে মৎস বিভাগের কিছুই করার নেই মন্তব্য করে নারায়ণ চন্দ্র মন্ডল বলেন, বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক এসাসিয়েশন (বিএফএফইএ) এব্যাপারে ভাল বলতে পারবে।
বাগেরহাট বারাকপুর মৎস্য আড়ৎদার সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাবিবুর রহমান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বারাকপুর মৎস্য আড়ৎ এ চিংড়ি বেচাকেনার ২০টি ডিপো রয়েছে। গত তিন মাসে এই সব ডিপো মালিক চাষীদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা চিংড়ি বাকিতে কিনেছে।
বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক এসাসিয়েশন (বিএফএফইএ) আন্তজার্তিক বাজারে বাগদা চিংড়ির বাজার দর ও চাহিদা কমে যাওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এজেন্টরা জানিয়েছে। চাষীদের এই পাওনা টাকা কবে নাগাদ আমরা পরিশোধ করতে পারবো তা নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। তাই এই চিংড়ি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
তবে এব্যাপারে বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক এসাসিয়েশন (বিএফএফইএ) সহসভাপতি এম খলিল উল্লাহ এর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।