দেশের উপকূলীয় ১১টি জেলায় আঘাত হানা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরের সাত বছর পূর্তি হলো আজ ১৫ নভেম্বর।
২০০৭ সালের এই দিনে ২৪০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন সাড়ে ৩ হাজার মানুষ। আর আহত ব্যক্তিদের সংখ্যা অর্ধলক্ষাধিক।
মহাদুর্যোগের ওই রাতে বাগেরহাটের মংলা উপজেলার চিলা এলাকার সেন্ট মেরিস গির্জাসংলগ্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছিলেন অন্তঃসত্ত্বা সাথী সরকার। তীব্র প্রসববেদনার মধ্যে অনাগত সন্তানের জীবন বাঁচাতে এখানে ছুটে এসেছিলেন এই মা। ঝড়ের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যন্ত্রণাও যেন বাড়তে থাকে। অবশেষে সূর্যোদয়ের আগে জন্ম দেন এক ফুটফুটে শিশু।
ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলার মাঝেই উপকূলীয় মানুষের সংগ্রামী জীবনের প্রতীক হয়ে ওঠে নবজাতকটি। তাই তার নাম রাখা হয় সিডর। ‘সিডর সরকার’।
ঘূর্ণিঝড় শেষে পত্রিকার পাতায়ও ঠাঁই করে নেয় সিডর সরকার। নবজাতক সিডরকে দেখতে ঘূর্ণিঝড়ের পরদিন ঢল নামে শত শত মানুষের। অনেকে সিডরের দরিদ্র পরিবারকে সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেন। গত বছর তাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হলে পরে আরও অনেকেই সাহায্যের আশ্বাস দেন। কিন্তু কথা রাখেননি কেউ।
এখনো যুদ্ধ থামেনি সিডরের পরিবারের। প্রকৃতির রুদ্ররোষ মাথায় নিয়ে যে শিশু পৃথিবীতে এসেছিল, সে কী করে যুদ্ধ ছাড়া চলবে? চলছে নিরন্তর বেঁচে থাকার যুদ্ধ। জীবনযোদ্ধা সিডর সাত বছর পূর্ণ করে আজ পা রাখল আট বছরে। গত বছর স্থানীয় দিশারী স্কুল থেকে ভালো ফল করে শিশু শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয় সে। এখন পড়ছে সেন্ট লুক স্কুলে।
সরেজমিন গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বার) বিকেলে মংলার কানাইনগর গ্রামে সিডরের ছোট থাকার ঘরে গিয়ে দেখা মেলে তার দাদির। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পাশে স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলছে সিডর। চরম দারিদ্র্যে পড়ে সিডরের বাবা জর্জি সরকার (৩৩) ও মা সাথী সরকার (২৮) বছর তিনেক আগেই ঢাকায় পাড়ি জমান।
কাজ নেন একটি পোশাক কারখানায়। ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর চেষ্টায় এখন তাঁরা চট্টগ্রামে। আর শিশু সিডর বাবা-মা ছেড়ে দাদির ঘরে।
চট্টগ্রামে সিডরের বাবা একটি দোকানে কর্মচারীর কাজ করেন। মা একটি পোশাক কারখানায়। দাদা রঞ্জিত সরকার সুন্দরবনে মাছ ধরার পেশা ছেড়ে চট্টগ্রামে একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ নিয়েছেন।
দাদি রিভা সরকার বলেন, সিডরের বাবা-মা সংসার চালানোর জন্য ঢাকায় যাওয়ার পর থেকেই সিডর আছে তাঁর কাছে। কিন্তু অনেক টাকা দেনা হয়ে পড়ায় মাস পাঁচেক আগে সিডরের দাদু কাজের খোঁজে চট্টগ্রাম চলে যান। ওর বাবা-মা নিজেদের আয় দিয়ে নিজেরা ঠিকমতো চলতে পারেন না। তার পরও বাসায় কিছু টাকা পাঠান। দাদুও কিছু পাঠান।
তা দিয়েই জোড়াতালিতে চলছে সিডরের পড়াশোনা আর খাওয়া খরচ। কয়েক বছর ধরে সিডর কানের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু এখনো কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো সম্ভব হয়নি।
মুঠোফোনে কথা হয় সিডরের বাবা জর্জির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সংগ্রাম করেই আমাদের মতো মানুষের বেঁচে থাকতে হয়। পত্রিকায় ছেলের ছবি ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে অনেকে অনেক কিছু করার আশ্বাস দেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই আদরের সন্তানকে রেখে চলে এসেছি চট্টগ্রামে। সিডরকে যেন মানুষ করতে পারি, সে জন্য কষ্ট করছি।’
নাড়িছেঁড়া ধনকে এত দূর রেখে থাকতে কেমন লাগছে—এমন প্রশ্নের জবাবে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন সিডরের মা। কিছু পর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এ যে কী কষ্ট, তা কি বলে বোঝানো যায়? নিজের কাছে রেখে সন্তান মানুষ করার খরচ আমাদের নেই। তাই বুকের কষ্ট বুকে জমিয়ে রেখে সংগ্রাম করছি।’