সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলা (বাগেরহাট) থেকে ফিরেঃ ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। ভয়াল সিডরের সে ধ্বংস স্তুপ থেকে গত ৭ বছরে অনেকটাই ঘুড়ে দড়িয়েছে বিদ্ধস্ত শরণখোলা।
ত্রান বা সাহায্য কিম্বা প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাস কোনটাই কম পাননি বলে দাবি এ জনপদের মানুষদের। তবে, প্রতিশ্রুত রায়েন্দা বাজার রক্ষা বা শহর রক্ষা বাঁধ এবং ক্ষতিগ্রস্থ বাঁধ গুলো সঠিক ভাবে সংঙ্কার হয়নি আজও।
সিডরের সাত বছর পার হলেও শরণখোলা উপজেলার প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র রায়েন্দা বাজার টিকে বাঁধের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি সরকার কবে বাস্তবায়ন করবে এমন প্রশ্ন এখানকার অধিবাসিদের।
আদৌ বাজারটিকে সরকার বাঁধের আওতায় আনবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে ব্যবসায়ীসহ বাজারের বাসিন্দাদের।
সিডরের ৭ বছর পরও পাওয়া না পাওয়া নিয়ে সরেজমিনে কথা বলতে গিয়ে বাগেরহাটের শরণখোলার স্থানীয়দের কাছ থেকে উঠে আসে এসব কাথা।
বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) সকালে শরণখোলার রায়েন্দা বাজারে পৌঁছেই আমাদের প্রথম গন্তব্য সিডরের সময় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবস্থায়ী সপন কুমার বালার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। কথা হয় তার স্ত্রী অনিমা নাগের সাথে। কেমন আছেন প্রশ্নে হাস্য উজ্জল ভালো থাকার কথা বললেও। সিডরের সে স্মৃতীর কথা এখন আর কিছুই মনে করতে চান না তিনি।
অনিমা নাগ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘সে দিনে স্মৃতি আর মনে করতে চাই না। সে দিনর পর বেঁচে আছি এটাই সৌভাগ্য। সিডরের রাত আমাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতোন। তার আর শরণ করতে চাইনা।’
সত বছর পর বর্তমান অবস্থা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন দূর্যোগের ভয়ে সব সময় তাড়া করে। বর্ষার সময় জোয়ারে ভাসে রায়েন্দা বাজার। বাঁধ থাকলেও এ অঞ্চলের মানুষের প্রানের দাবি রায়েন্দা বাজার এখনও বাধেঁর বাইরে।
সকাল পৌনে ১০ টার দিকে রায়েন্দা বাজারের দক্ষিন প্রান্তের একটি চায়ের দোকানে শুরু হয় সিডর বিদ্ধস্ত এলকার মানুষের সাথে আমাদের কথপকথন। ওই দোকানে তখন দোকানি ছাড়াও ছিলেন আরো ৬-৭ জন।
সিডর হয়ে গেল তো ৭ সাত বছর। এখন কেমন আছেন? কি পেলেন আর কি পেলেন না ?
এমন প্রশ্নে বেশ সহজ সরল উত্তর- আমরা তেরান (ত্রান) পাইছি অনেক। কিন্তু এহনও (এখনও) বাঁধ হইনি (হয় নি)। মাত্র দেড় থেইকা দু’কিলোমিটারের একখান বাঁধা দিয়েদিলিই (দিলে) আমগো বাজার বাঁতো, আমরা বাঁচতাম।
শরণখোলা উপজেলা আওয়ামীগ কার্যালয়ের বিপরীতে ওই চায়ের দোকানে বসে ৩নাং রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়াডের সাবেক মেম্বার হাবিবুর রহমান ফকির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, শরণখোলা উপজেলার প্রান কেন্দ্র এই রায়েন্দা বাজার। এ বাজারই উপজেলা ব্যবসা-বানিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র বিন্দু। কিন্তু এত বছর পরও বাস্তবায়ন হয়নি এখানকার মানুষের প্রাণের দাবি ‘রায়েন্দা বাজারকে বেড়ি বাঁধের আওতায় আনা’।
তিনি বলেন, এখনও সঠিক ভাবে হয়নি ক্ষিতিগ্রস্ত বাঁধ সংঙ্কারের কাজ। সিডরের পর রায়েন্দা বাজাররের চার পাশে বেড়িবাধ নির্মানের কাজ যেমন হয় নি। হয়নি ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ গুলো আরো দু’ফুট উঁচু করে সঠিক ভাবে সংঙ্কারের কাজ।
তার এসব দাবির সাথে একমত জানিয়ে সঞ্চিব কর্মকার (৩৩) ও আবুল হাওলাদার (৩০) বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, আমাদের কোন সাহায্য চাইনা। শুধু এই বাঁধটা একটু করেদেন। আর বাগেরহাট থেকে আমাদের শরণখোলা আসার রাস্তাটা ভালো কারে দেন।
তারা জানান, সেই দিনে সিডরের জলোচ্ছ্বাসের পানিতে এই বাজারের ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল। সিডরের পর ২০০৯ সালের আইলার পানিতেও বাজারটি আবার ভেসে যায়। এছাড়া অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারেও মাঝে মাঝে বাজারে পানি উঠে তলিয়ে যায়।
শরণখোলা উত্তর কদমতলা এলাকার বাঁধের বাইরে বলেশ্বর নদের তীরে বসবাস করা ফরোজা বেগম (৪০) ও আব্দুস সোবাহান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের জলোচ্ছ্বাসে আমাদের সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সিডরের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু আমাদের বসবাস বাঁধের বাইরে হওয়ায় দুর্যোগের পূর্বাভাস পেলেই সব সময় আতংকে থাকি।
“আবার বুঝি আমরা নি:স্ব হয়ে যাব।”
তারা বলেন, সিডরের পরে সরকার বিভিন্ন সময়ে শরণখোলা উপজেলা সদরের রায়েন্দা বাজারকে বাঁধের আওতায় আনতে জরিপ করেছে কিন্তু গত সাত বছরেও তা বাস্তবায়ন করেনি।
রায়েন্দা বাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বলেশ্বর নদের তীরের অবস্থিত এই বাজারটিতে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত আড়াই হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দুর্যোগের পূর্বাভাস এলেই আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ থাকেনা। এই বুঝি আমাদের দোকানে পানি উঠে তলিয়ে যায়।
অসংখ্যবার জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের পানি উঠে আমাদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। বাজারটিকে বাঁধের আওতায় আনতে কমিটি করে আন্দোলন সংগ্রাম করা হয়েছে। কিন্তু গত সাত বছরেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় তিনি সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
স্থানীয় সাংবাদিক ইসমাঈল হোসেন লিটন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় সিডরের জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত শরণখোলা উপজেলার বাসিন্দাদের সরকারী, বেসরকারী ও ব্যক্তি পর্যায়ে সাহায্য করা হয়েছে। এই উপজেলার মানুষ সিডরের ক্ষত কাটিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক চেহারায় ফিরেছে, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সিডরের পর বলেশ্বর নদের তীরের প্রধান বানিজ্য কেন্দ্র রায়েন্দা বাজারের ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের দাবি ছিল রায়েন্দা বাজারটিকে বাঁধের আওতায় আনার।
রায়েন্দা বাজার দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মিলন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীদৈর দাবীর মূখে পানি উন্নয়ন বোর্ড গত সাত বছরে অষংখ্যবার বাঁধ নির্মানে ব্যাপারে জরিপ করেছে। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
আদৌ বাজারটিকে সরকার বাঁধের আওতায় আনবে কিনা তা নিয়ে বাজারের ব্যবসায়ীরাসহ বাজারের বাসিন্দারা সংশয় প্রকাশ করেছেন। রায়েন্দা বাজারটি বাঁধের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি তিনি জোর দাবি জানান তিনি।
সরকার ওই সময়ে আমাদের বাঁধটি করে দেবে বলে প্রতিশ্রুতিও দেয়। এই বাঁধটি সরকার বাস্তবায়ন করতে একাধিকবার জরিপ করে। বাঁধটি জরিপেই আটকে রয়েছে। বাস্তবায়ন হয়নি পুরোন বেড়িবাঁধ সঠিক ভাবে সংঙ্কার ও আরো দুই ফুট উচু করার প্রতিশ্রুতিও।
তবে এবিষয়ে বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মইন উদ্দিন আবারও শুনালেন প্রতিশ্রতি।
তিনি বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড রায়েন্দা বাজারকে বাঁধের আওতায় আনতে নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এই বাঁধ নির্মান করা হবে। তারই অংশ হিসাবে ইতিমধ্যে জমি অধিগ্রহণের কাজও শুরু হয়েছে।