বাগেরহাটের পুরোনো মংলা বন্দর আবাসিক এলাকায় শ্রমিকদের থাকার ৭৫টি পাকা আধা-পাকা স্থাপনা সব গুলোই এখন জরাজীর্ণ।
এসব স্থাপনায় নেই পানি ও বিদ্যুতের সংযোগও । তবু বন্দরের শ্রমিকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই এখানে বসবাস করছেন।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্পত্তি শাখা সূত্রে জানা গেছে, আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে নব্বইয়ের শেষ ভাগ পর্যন্ত বন্দরের শ্রমিকদের বাসস্থানের জন্য পুরোনো মংলা বন্দর আবাসিক এলাকায় ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ডের অর্থায়নে পাঁচটি পাঁচতলা, একটি তিনতলা, ছয়টি দোতলা, নয়টি একতলা ও ১২টি আধা পাকা (টিনশেড) ভবন নির্মাণ করা হয়।
এসব ভবনে কুমিল্লা, নোয়াখালী, বরিশাল, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলাসহ বিভিন্ন এলাকার এক হাজার ৭৫৮ জন নিবন্ধিত এবং ৮৯৬ জন অনিবন্ধিত শ্রমিক নিজ নিজ পরিজন নিয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বসবাস করছিলেন। ২০০৮ সালে রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ড বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে ভবনগুলো বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ওই অধ্যাদেশের বলে এসব শ্রমিকের নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, যেসব ভবনে শ্রমিকেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন, সব কটিতেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে বন্দর কর্তৃপক্ষের সাইনবোর্ড টাঙানো। ২০০৮ সালের পর সংস্কার না করায় অধিকাংশ ভবনই জরাজীর্ণ। পলেস্তার খসে পড়েছে। জানালার গ্রিল নেই। ঘরের দেয়ালে ফাটল, ভেতরে স্যাঁতসেঁতে। কোনো ভবনেই বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ নেই।
বিলুপ্ত মংলা বন্দর শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক মো. সাহাবউদ্দিন বলেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শ্রমিকদের স্বার্থ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ওই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। দীর্ঘ দুই-তিন যুগ ধরে যাঁরা বন্দরে শ্রমিক হিসেবে শ্রম দিয়ে এসেছেন, হঠাৎ করে তাঁদের সব সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিয়ে তাঁদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হলো। অর্ধেকের বেশি শ্রমিক স্বেচ্ছা-অবসরের টাকা নিয়ে চলে গেছেন। যাঁদের পাওনাদি পরিশোধ হয়নি, তাঁরা যেতে পারেননি।
ভবনে বসবাসরত বন্দরের হ্যান্ডলিং শাখার শ্রমিক আবদুল কাদের বলেন, ‘শ্রমিক হিসেবে মংলায় কাজ করছি সেই নব্বই সাল থেকে। এত বছর ধরে মংলা বন্দর আমাদের শ্রমের ঘামে টিকে আছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রতি একটু সদয় হবে না? বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি ভবনগুলা সংস্কার করে দেয়, তাহলে তাদের নিয়ম মেনেই আমরা থাকব।’
বন্দরের শ্রমিক আলী আজম (৬০) বলেন, ‘২০১২ সাল থেকে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের জুন মাস থেকে ভবনে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড টাঙিয়েছে। তার পরও এই ভবন ছেড়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই আমাদের। কারণ, বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রাপ্য পাওনা এখনো পরিশোধ করেনি।’ বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (সম্পত্তি) হাওলাদার জাকির হোসেন বলেন, ‘ডক শ্রমিক ব্যবস্থাপনা বোর্ড বিলুপ্ত হওয়ার কারণে এই শ্রমিকেরা আইনগতভাবে আর মংলা বন্দরের শ্রমিক নন।
২০১১ সালে স্বেচ্ছা-অবসরের টাকা দেওয়ার পর আমরা তাঁদের এসব ভবন ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। কিন্তু তাঁরা এই ভবন ছাড়েননি। এসব ভবনের দীর্ঘ এক যুগের বিদ্যুৎ ও পানির বকেয়া বিল ২০ লাখ টাকার বেশি ছিল। নিরীক্ষার পর ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা বাধ্য হই বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে। আর বন্দরের পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় আমরা ভবন সংস্কারের কাজে হাত দিতে পারিনি।’
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘বিষয়টি মানবিক। আমরা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন খালি করতে পারতাম। কিন্তু শ্রমিকেরা বর্তমানে বন্দরের নিবন্ধিত না হলেও তাঁদের শ্রমেই বন্দর আজকের পর্যায়ে। তাঁরাই মূলত বন্দরের জাহাজের পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজ করছেন।’
তাই কটি ভবন সংস্কার করা যায়, কোন প্রক্রিয়ায় তাঁদের বাসস্থানের সমাধান করা যায়, সে জন্য আমরা একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। সেই কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই সমস্যার সমাধান করে ফেলব।