সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সুন্দরবনসহ উপকূলের নদ-নদীতে দেদারছে চলছে বাগদা চিংড়ির পোনা (রেনু) আহরণ।
প্রকাশ্যে বিভিন্ন নদ-নদীতে প্রায় সারা বছর ধরে চলে এ চিংড়ি রেনু পোনা আহরণ। চিংড়ি পোনা আহরণের কারণে বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য এখন হুমকির মুখে।
এরই মধ্যে ২৮ প্রজাতির সাদা মাছ বিপন্ন হয়ে গেছে। সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে আরো ১৪ প্রজাতির মাছ।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) নামের একটি গবেষণা প্রতিবেদন দেখা গেছে, একটি চিংড়ি পোনা ধরতে গিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির এক হাজার থেকে বারো শ পোনা নষ্ট হচ্ছে। চিংড়ি পোনা আহরণের কারণে ক্ষতির প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। উপকূলের কয়েক লাখ মানুষ চিংড়ি পোনা আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
এ অবস্থায় চিংড়ি পোনা আহরণ বন্ধ রাখতে তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে আইইউসিএন ওই প্রতিবেদনে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপকূলবর্তী বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষ চিংড়ি পোনা আহরণের সঙ্গে জড়িত। প্রায় সারা বছর ধরে তারা এসব জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত পশুর, পানগুছি, বলেশ্বর, শিবসা, কয়রা, ভদ্রা, কপোতাক্ষ, ইছামতি, কাকশিয়ালী, কালিন্দি, খলপেটুয়া, মাদার, আন্ধারমানিক, বিশখালী, মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চল, কর্ণফুলী, পতেঙ্গা, টেকনাফ, কুতুবদিয়া, নাফ, চকরিয়া চ্যানেলসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন নদ-নদীতে জাল দিয়ে বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণ করে থাকে। তবে তা ব্যাপকভাবে চলে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত।
মাঝেমধ্যে কোস্টগার্ড, বন বিভাগ, মৎস্য বিভাগ ও পুলিশ উপকূলের বিভিন্ন নদ-নদীতে অভিযান চালিয়ে চিংড়ি পোনা আহরণের বিপুল পরিমাণ জাল উদ্ধার করলেও পোনা আহরণ পুরোপুরি বন্ধ করা যায় না।
বাগেরহাটের মংলা উপজেলার সুন্দরবন-সংলগ্ন পশুর, শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার পানগুছি নদীতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ প্রাকৃতিক উৎস থেকে বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণ করছে। নিষিদ্ধ ক্ষুদ্র ফাঁসের জাল দিয়ে ভাটার সময় পোনা ধরছে তারা। চিংড়ি পোনা ধরার সময় বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ নষ্ট করছে তারা।
চিংড়ি পোনা আহরণের পর তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। ভাটার সময় একজন ২০০ থেকে ৩০০ টাকার চিংড়ি পোনা আহরণ করে থাকে। কোনো কোনো এলাকায় মহাজনরা দাদন দিয়ে চিংড়ি পোনা আহরণ করিয়ে থাকে।
সুন্দরবন-সংলগ্ন পশুর নদীতে চিংড়ি পোনা আহরণকারী বাগেরহাটের মংলা উপজেলার কাইনমারী গ্রামের মজিদ শেখ, বলেশ্বর নদে পোনা আহরণকারী শরণখোলার বগী গ্রামের হাফিজ শেখ, গাবতলা গ্রামের মমতাজ আক্তার, কুদ্দুস আকন, পানগুছি নদীতে পোনা আহরণকারী মোরেলগঞ্জের ছোলমবাড়িয়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও বারুইখালী গ্রামের দিলরুবা খাতুন জানান, বিকল্প আয়ের পথ না থাকায় বাধ্য হয়ে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে চিংড়ির পোনা আহরণ করছেন। প্রতিদিন ভাটার সময় ছোট জাল দিয়ে শুধু বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণ করেন। পরে স্থানীয় পোনা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে যে অর্থ পান, তা দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে আছেন।
তবে তাঁরা কেউই জানেন না চিংড়ি পোনা আহরণের কারণে অন্য প্রজাতির মাছ নষ্ট হচ্ছে। তাঁরা মনে করেন, নদ-নদী থেকে চিংড়ি পোনা আহরণ বন্ধ রাখতে হলে তাঁদের বিকল্প কর্মসংস্থানের প্রয়োজন।
বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খান কামাল উদ্দিন জানান, নদ-নদী থেকে চিংড়ি পোনা আহরণ নিষিদ্ধ। কিন্তু গলদার অনেক হ্যাচারি বন্ধ থাকায় মানুষ প্রাকৃতিক উৎস থেকে চিংড়ির পোনা আহরণ করছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য কনজারভেশন অব নেচারের গবেষণার বরাত দিয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শহীদুল ইসলাম জানান, উপকূলবর্তী ৯টি জেলার ২১টি উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কয়েকটি ধাপে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। তাতে দেখা যায়, জাল দিয়ে একটি বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণের সময় বিভিন্ন প্রজাতির ১৫৮টি চিংড়ি, ৪১টি সাদা মাছ ও ১৫৭টি ম্যাক্রোজুপ্যাংকটন (মাছের এক ধরনের খাবার) মিলিয়ে প্রায় এক হাজার থেকে বারো শ পোনা নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া এরই মধ্যে ২৮ প্রজাতির সাদা মাছ বিপন্ন হয়ে গেছে, ১৪ প্রজাতির মাছ সংকটাপন্ন এবং ১২ প্রজাতি মহাসংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। চিংড়ি পোনা আহরণের কারণে একই সঙ্গে জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে রয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, সুন্দরবনের ভেতরে ৪৫০টি নদী ও খাল রয়েছে। এর নো ফিশিং জোন এলাকায় চিংড়ি পোনা আহরণ করতে দেওয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে তারা অভিযান চালিয়ে চিংড়ি আহরণের জাল জব্দ করেছেন।
কোস্টগার্ড মংলা পশ্চিম জোনের অপারেশন বিভাগের স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম আলাউদ্দিন নয়ন জানান, কোস্টগার্ড সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে নদ-নদীতে অভিযান চালিয়ে পোনা ধরার নিষিদ্ধ জাল জব্দ করেছেন। পরে প্রকাশ্যে ওই জাল পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। কেউ যাতে নদ-নদীতে চিংড়ি পোনা ধরতে না পারে সে জন্য তাঁদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।