বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমায় নানা ধরণের খনিজ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের বিশাল সম্ভার।
তবে উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেদের দাবি প্রতি বছর এদেশের কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ আহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে ভিনদেশি জেলেরা।
ভিনদেশি বিশেষ করে ভারতীয় জেলেদের অবাধ বিচরণ চলে সুন্দরবন উপকূলের বাংলাদেশ অংশের সাগরের বিশাল জলসীমায়।
স্থানীয় জেলেদের দাবি, শীত মৌসুমের শুরুতে ভারতীয় জেলেরা তাদের মাছ ধরা ট্রলার নিয়ে বাংলাদেশ উপকূলে প্রবেশ করে কোটি কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ লুটে নিচ্ছে।
অবশ্য জেলেদের এ অভিযোগের অনেকটা সত্যতা মিলেছে সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় নৌ বাহিনীর হাতে ৪টি ফিশিং ট্রলারসহ ৫৫ ভারতীয় জেলে আটকের ঘটনায়।
সর্বশেষ গত বুধবার (২২ অক্টোবর) দুপুরে মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে প্রায় ৯০ নটিক্যাল মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে বয়া এলাকায় মাছ শিকারের সময় ‘এফবি আবির’ নামে একটি ভারতীয় ট্রলারসহ ১৩ জেলেকে আটক করে নৌ বাহিনীর সদস্যরা।
এর আগে ১৫, ১৮ ও ২০ অক্টোবর একই এলাকা থেকে পৃথক অভিযান চালিয়ে ৪২ ভারতীয় জেলেকে আটক করে নৌ বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ শিকারের অপরাধে মামলার পর বাগেরহাট জেলহাজতে পাঠানো হয়।
বাগেরহাট, শরণখোলা, মংলা ও বরগুনার পাথারঘাটা উপকূলের জেলে ও মহাজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবছর বিশেষ করে অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশি জেলেরা বঙ্গোপসাগরের গভীরে ট্রলার নিয়ে মাছ আহরণে যায়। এ সময় সাগর শান্ত থাকে। তাই জেলেদের মাছ আহরণের উপযুক্ত মৌসুম এটা। কিন্তু এ সময় বেড়ে যায় সাগরে ভারতীয় ট্রলারের আনাগোনা।
বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার বাসতলি ইউনিয়েনর তালবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা এবং সুন্দরবনের আলোরকোল শুটকি পল্লীর মৎসজীবী শুকুর হাওলাদার (৩৬) বাংলানিউজকে বলেন, ভারতীয় জেলেরা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ঢুকে মাছ শিকার করে। তারা অধিকাংশ সময়ই গোপনে মাছ শিকার করে চলে যায়।
আর এদেশীয় জেলেদের সঙ্গে তাদের দেখা হলে নানা প্রকার ভয়-ভীতি দেখায়। ভারতীয় জেলেদের অনেক ট্রলারে অস্ত্র থাকে বলেও অভিযোগ তার।
সুন্দরবন উপকূলের জেলেপল্লী দুবলার চরেরমেহের আলীর টেকের জেলে মহাজন চট্টগ্রামের শুক্কুর, অনিল বরণ দাস, শুঁটকি ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ এবং জেলে উজ্জ্বল কান্তি অভিযোগ জানান, পাশের দেশ ভারত, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড থেকে জেলেরা অবৈধভাবে বড় বড় অত্যাধুনিক ট্রলার নিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকছে। বিদেশি জেলেরা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার দিয়ে ট্রলারে বসে নৌ বাহিনীর তৎপরতায় চোখ রাখে। নৌ বাহিনী আসতে দেখলেই দ্রুত পালিয়ে যায় তারা।
শরণখোলার মাছধরা ট্রলার এফবি মানিকের সারেং রায়মোহন মাঝি বলেন, ভারতীয়রা বাংলাদেশি জেলেদের বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি ও হুমকি দিয়ে মাছ ধরতে বাধা দেয়। কখনও কখনও ভারতীয়রা বাংলাদেশি জেলেদের ট্রলার ও নৌকায় হামলা চালায়, জেলেদের মারধর করে এবং লুটপাট চালায়।
সুন্দরবনের দুবলারচর সংলগ্ন শ্যালারচর, ছাপড়াখালী, আলোরকোল, মাঝের কিল্লা, অফিস কিল্লা এবং নারকেল বাড়িয়ার জেলেপল্লীর আলী হোসেন, জাহাঙ্গীর মাঝি, খালেক মাঝি, বাবুল মাঝি ও লোকমান মাঝিসহ অনেকেই একই ধরনের অভিযোগের কথা জানিয়েছেন।
তারা বলেন, গভীর সমুদ্রে মাছ থাকলেও ভারতীয় জেলেদের কারণে তাদের মাছ ধরা ব্যাহত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জাতীয় মৎসজীবী সমিতি শরণখোলা শাখার সভাপতি আবুল হোসেন বাগেরহাটি ইনফো ডটকমকে বলেন, জেলেরা প্রতিনিয়ত ঝড়-ঝঞ্জা, দস্যুতা আর নানা রকম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে সাগরে যায়। কিন্তু ইদানিং বিদেশি জেলেদের কারণে তারা ঠিকভাবে মাছ শিকার করতে পারছে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জলসীমা থেকে ভারতের কাকদ্বীপ এলাকার কাছে হওয়ায় সেখানকার বিপুলসংখ্যক জেলে এ দেশের জলসীমায় মাছ ধরতে আসে। মাছ ধরার অত্যাধুনিক জালসহ আধুনিক বিভিন্ন সরঞ্জাম থাকায় তারা অনেক বেশি মাছ আহরণ করতে পারে।
বাংলাদেশের জলসীমায় যে এলাকায় মাছের পরিমাণ বেশি, সাধারণত সেই এলাকায় তারা মাছ শিকার করে। তাদের দৌরাত্ম্যে বাংলাদেশি জেলেরা ওইসব এলাকায় মাছ শিকার করতে পারেন না বলে তিনি জানান।
সুন্দরবন এবং উপকূলে তিমি রক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির পরিচালক এলিজাবেথ ফাহর্নি মানসুর বাগেরহাটি ইনফো ডটকমকে জানান, সুন্দরবনের দুবলার চর থেকে ৩০ কিলোমিটার দুরে বঙ্গোপসাগরে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এলাকায় ডলফিন, তিমিসহ অন্যান্য প্রজাতির মাছের প্রাচুর্য রয়েছে।
হিসাব করে দেখা গেছে বঙ্গোপসাগরে সম্প্রতি আটক ৫৫ জেলেকে সোয়াচ অভ নো গ্রাউন্ড এলাকায় মাছ ধরার সময় আটক করা হয়েছে।
সাগরে ভারতীয় জেলেদের উৎপাত বেশি উল্লেখ করে মংলার চিলা ইউনিয়নের বাসিন্দা জেলে হেমায়েত হাওলাদার বলেন, ভারতীয় জেলেরা কারেন্ট জালসহ ৫ ধরনের অত্যাধুনিক জাল ব্যবহার করেন। পাশাপাশি মাছের পোনাও ধরে। তাদের কাছে রয়েছে জিপিএস (বিশেষ সংকেত প্রেরণর যন্ত্র)। এ যন্ত্রের মাধ্যমে ভারতীয় জেলেরা যে পথ দিয়ে সাগরে আসে, আবার সে পথ দিয়েই ফিরে যায়।
সুন্দরবনের মৎস্যজীবী জাবেদ হোসেন জানান, বঙ্গোপসাগরে ভারতীয় ফিশিং ট্রলার বাংলাদেশির সমুদ্রসীমার প্রায় দেড়শ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করে মাছ ধরছে। বাংলাদেশের জেলেরা সেখানে গেলে তারা হামলা চালাচ্ছে।
দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মো. কামাল উদ্দিন আহম্মদ বাগেরহাটি ইনফোকে বলেন, শুধু দু’একটি ভারতীয় ট্রলার আর জেলেদের আটক করে সাগরে ভিনদেশিদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা যাবে না। তাই নৌ বাহিনী ও উপকূলরক্ষী বাহিনী কোস্টগার্ডের প্রতি সমুদ্রে বাংলাদেশের সম্পদ রক্ষায় আরো উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাগেরহাটি ইনফো ডটকমকে বলেন, প্রায় সবসময়ই ভারত ও থাইল্যান্ডের জেলেরা দেশীয় জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যায়। ফলে আমাদের সমুদ্রসম্পদ আহরণ কমে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন কাজী মাসুদ মেহেদী বাগেরহাটি ইনফো ডটকমকে বলেন, উপকূলরক্ষী বাহিনী হিসেবে কোস্টগার্ড জেলেদের নিরাপত্তায় কাজ করে। তবে গভীর সমুদ্রের নিরাপত্তার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখে নৌ বাহিনী।
এ বিষয়ে গভীর বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নৌ-বাহিনীর বরাত দিয়ে মংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বেলায়েত হোসেন বাগেরহাটি ইনফো ডটকমকে বলেন, নৌ বাহিনী নিয়মিত টহলে ৪ দফায় ৪টি ভারতীয় ট্রলারসহ ৫৫ জেলেকে আটক করে মংলা থানায় হস্তান্তর করে। এদের মধ্যে ৪৪ জনকে আদালতের মাধ্যমে বাগেরহাট জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকি ১৩ জনকে শুক্রবার আদালতে পাঠানো হবে।