একপাশে জনবসতি আরেক পাশে বাঘ-হরিণ-বানর সহ নানান জীবজন্তুর বাস। একপাশে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া সহ নানান গাছ আরেক পাশে রেন্ট্রি, খেজুর, নারিকেল সহ নানা বৃক্ষ অর্থাৎ এক পাশে সুন্দরবন, আরেক পাশে লোকালয়।
মাঝ দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে খাল। খালে বা ডাঙ্গায় কুমির যে নেই, তাও নয়।
ভাটার টানে খালের পানি কমছে। পরের স্টেশন ধানসাগর। স্রোরােতের বিপরীতে স্পীড বোট এগিয়ে যাচ্ছে।
জাল নিয়ে খালে দুই শিশু মাছ ধরার দৃশ্য চোখে পড়ল। বোট দেখে তারা খালের পাশ দিয়ে পিছু ছুটল। কিছু দূর এগোনের পর চালক বললেন খাল শুকিয়ে গেছে। আর যাওয়া যাবে না। বেশ দুঃচিন্তয় পড়লাম সবাই। কারণ সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনে গিয়ে আমাদের দুপুরের খাবার খেতে হবে।
চাঁদপাই রেঞ্জ কর্মকর্তাও সাথে ছিলেন। তিনি লোকালয় থেকে মটর সাইকেলে যাবার কথা বললেন। কিভাবে যাব- সে ব্যাপারেই তারা কথা বলছিল। বামে লোকালয়ে একটি খাল ঢুকেছে। সেখানে মাছ ধরছে অনেকে। সেই খালের মুখে বোট রাখা হল।
এবার লোকালয়ে উঠতে হবে । খালের পাশে কাঁদা। কাঁদা পায়ে না লাগিয়ে লোকালয়ে ওঠার ব্যবস্থা করছেন বনপ্রহরীরা। চালকের কাছে তখন দাড়িয়ে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগীয় কর্মকর্তার সাথে কথা বলছিলেন।
এমন সময় কয়েক শিশু বোটের পিছনে ঘোলা পানিতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছিল। হাতে জাল। কারো হাতে মাছের পাত্র। আছে বরশি। ‘জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ’- এটি যেন তাদের কাছে প্রবাদ বাক্য ছাড়া আর কিছুই না! নেই তাদের বাঘের ভয়, নেই কুমিরের!
কি করে জানতে চাইলে বলল, মাছ ধরে এবং কাঠ কাটে। সবুজ নামের এক শিশু বলল, সে নেট জাল দিয়ে চিংড়ির পোনা ধরে।
শিশু সোহেল জানালেন, সে বরশি দিয়ে মাছ ধরেন। প্রতিদিন ৭০/৮০ টাকা আয় করেন। আরেক শিশু জানালেন, খাওয়ার জন্য মাছ ধরতে এসেছেন। সাথে তার ভাইও আছে। সে বনে গিয়ে রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ আনবেন।
বনে যেতে বা পানিতে নামতে ভয় লাগে না ? জবাবে হাঁসল এবং মাথা ঝুলিয়ে জানিয়ে দিল ,জল-জঙ্গলেই তাদের জন্ম। তাদের খেতে-পরতে দেয়। সেখানেই তারা বড় হচ্ছে। জল-জঙ্গলের সাথে যেন তাদের নাড়ির বন্ধন।
সব ক’জনের বয়স বারোর নিচে। এসব শিশুর কেউই স্কুলে যায় না। লেখাপড়া করে না। ৬/৭ বছর বয়স থেকেই বনের উপর নির্ভর হতে শুরু করে। বাবা-মায়ের সাথে মাছ ধরে, বনে কাঠ কাটে। শুধু ছেলেরা না, মেয়েরাও।
ভাবাই যায় না! এই বয়সে ঢাকার শিশুরা কি করে বা মফস্বল শহরের শিশুরাই-বা কি করে! এই বয়স ঢাকা বা মফস্বল শহরের শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুর সময়। অথচ এসময়ে সুন্দরবন সংলগ্ন লেকালয়ের শিশুরা বাস্তবতার স্কুলে শিক্ষা শুরু করে! পাঠশালা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; জল-জঙ্গল!
এবিষয়ে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আমীর হোসাইন চৌধুরী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন ১৭ উপজেলার প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। মাছ ধরাই মূল পেশা। মানুষ যে পরিবেশে থাকে সেই পরিবেশই তার উপর প্রভাব ফেলে। শিশুদের সাথে নিয়ে তাদের পিতা মাছ ধরতে, বনে কাঠ কাটতে যায়।
ফলে এসব শিশুরা মাছ ধরা, কাঠ কাটা শেখে । এভাবেই এসব শিশুরা বেড়ে ওঠে। আবার বড় হয়ে অনেকে শুরু করে দস্যুতা।
তিনি আরো বলেন, একটি প্রজন্মকে যদি টার্গেটে নিয়ে স্কুল মুখী করে যদি এসএসসি পার করা যেত, তাহলে তারা আর জাল নিয়ে নদীতে নামতো না, কাঠ কাটতো, করতো না দস্যুতা। বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে জানলে এসব করতে তাদের সম্মাণে বাধতো। তখন তারা উচ্চ শিক্ষার দিকে আগ্রহী হতো। তারা সচেতন হলে সুন্দরবনের ক্ষতি করতো না। বনের উপর নির্ভরশীল হতো, তা অন্য ভাবে বা টুরিস্ট গাইড হয়ে ।