বয়স্ক ভারী গলার কাশির শব্দের মতো খক্ খক্, খেকর খেকর ডাক। আর যেকোনো সময় মাথায় কটু চোনা গন্ধের বিষ্ঠার দলার স্পর্শের আশঙ্কা মেনে নিয়েই বাগেরহাট শহরবাসী পুরোনো কোর্ট চত্বরসংলগ্ন রাস্তা দিয়ে চলাচল করে আসছেন।
কারণ, এখানকার গাছগুলোতে রয়েছে অতি চেনা ছোট পানকৌড়িদের বেশ বড় একটি আবাসস্থল বা কলোনি। মাত্র দেড় শ গজ পূর্বে শহরপ্রান্তে বয়ে চলেছে দড়াটানা নদী। গাছগাছালিতে আবৃত তুলনামূলক নিভৃত এই এলাকাটি এক যুগের বেশি সময় ধরে ওই পানকৌড়িদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে।
শহরের মানুষও ওদের এই আসা-যাওয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাই তো এখানে এলেই অজান্তে হুডে হাত যায় রিকশার আরোহীর। বই, খাতা, ছাতা মাথায় ধরেন পথচারী ও ছাত্র-ছাত্রীরা। কেউবা রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা বিষ্ঠার দাগের সীমানা থেকে দূরত্ব রেখে রাস্তাটুকু অতিক্রম করেন। এই অভ্যস্ততার কারণে অধিকাংশ সময়ই মাথার ওপরের এই ছোট ছোট প্রাণের মেলা যেন পথচারীদের চোখ এড়িয়ে যায়।
ছোট পানকৌড়িরা এখানে আসে জ্যৈষ্ঠ মাসে। তারা জোড় বাঁধে, বাসা বানায়, ডিম দেয়, বাচ্চা ফোটায়। আবার বাচ্চা বড় করে আশ্বিনের প্রথম দিকে তারা উড়ে যায় তুলনামূলক আরও ভালো কোনো আশ্রয়ের উদ্দেশে। তবে ফাঁকা থাকে না গাছগুলো। ওরা চলে যেতেই অগ্রহায়ণে আসে সাদা বকের দল, শালিক আর চড়ুই। বকের দল বাচ্চা তুলে ফিরে যায় বৈশাখের শেষে।
তবে এখানে বকদের অবস্থান পানকৌড়িদের মতো সরব নয়। কারণ, বাচ্চাদের খাবার দিতে পানকৌড়িদের মতো তারা ছোট দূরত্ব থেকে বারবার মাছ নিয়ে বাসায় ফেরে না। খাবারের জন্য তারা অনেকটা দূরের পথে উড়ে যায়। দু-একবার ফেরে দলছুট হয়ে। সন্ধ্যায় ফিরে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে, বড় বড় দলে।
ছোট পানকৌড়ি আমাদের দেশের একটি স্থায়ী পাখি। মাছ ওদের একমাত্র খাদ্য। আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে এরা অতিপরিচিত। কালো শরীরে ছড়ানো লেজ, কালো হাঁসের মতো পা। সাপের মতো লম্বা বাঁকানো গ্রীবা, সুচালো বাঁকা ঠোঁট। প্রজননকালে শরীরের কালো রং কিছুটা ফিকে হয়। সচরাচর দেখা যায় নদী ও বিল এলাকায়।
উঁচু গাছে ডালপালা দিয়ে বাসা বাঁধে। ছোট পানকৌড়ি দুই থেকে ছয়টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। ছেলেমেয়ে উভয় পাখি পালাক্রমে ডিমে তা দেয়। বাচ্চা ফুটতে লাগে ১৭ থেকে ২১ দিন। দেশের নদী অঞ্চলের মাছের ঘেরে এদের বিচরণ নিয়মিত। ডুবসাঁতারে মাছ ধরতে এই ছোট পানকৌড়ি অনেক সময় দুঃসাহস দেখিয়ে বাড়ির পুকুরেও নেমে পড়ে।
বাগেরহাট পুরোনো আদালত চত্বর, বাগেরহাট সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন, জেলা প্রশাসকের বাসভবন, জেলা রেকর্ড রুম, কোর্ট মসজিদ চত্বর আর জেলা সিআইডি কার্যালয় ঘিরে ২৫-৩০টি গাছে এই পানকৌড়ি কলোনি। স্বাধীনতা উদ্যানের সামনে দিয়ে পূর্বমুখী রাস্তাটি এই কলোনির প্রধান বসতির নিচে জেলা প্রশাসকের বাসভবনের সামনে এসে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে।
রেকর্ড রুমকে বামে রেখে একটি রাস্তাটি চলে গেছে লঞ্চঘাটের দিকে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে হলেও পানকৌড়ি কলোনির অধিকাংশ এলাকাই সরকাির জমি, নিরিবিলি। এখানে সাধারণ মানুষের বসতি নেই বললেই চলে।
তবে তারা যে এখানে খুবই নিরাপদ, তা নয়। ঝড়-বৃষ্টির সময় বাতাসে গাছ থেকে বাচ্চা পড়ে যায়। আবার ছোট বাচ্চারা বাসা ছেড়ে বের হতে গিয়ে মাটিতে পড়ে কুকুর-বিড়ালের খাদ্য হয়। আছে শিকাির পাখির উপদ্রব।
স্থানীয় প্রবীন জনরা জানান, নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে এখানে পাখি আসে। বিগত সময়ে এ এলাকায় গাছের ডাল কেটে পাখিদের থাকার ব্যবস্থা নষ্ট করা হয়েছিল।
সিপিবি’র বাগেরহাট জেলা শাখার সাধারন সম্পাদক ফররুখ হাসান জুয়েল বলেন, পুরাতন কোর্ট এলাকায় দলীয় কার্যালয় হওয়ায় দিনের বেশীরভাগ সময় আমি এই চত্ত্বরে থাকি। বক-পানকৌড়িদের প্রতি মানুষের কোন অন্যায় আচরণ আমার নজরে আসলে তার প্রতিবাদ করি।
তবে ইদানিং এখানে পাখি ধরা ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। মাঝে মাঝে বাজারে বিক্রী হয় শুনেছি। এগুলো বন্ধ করতে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।
পাখিদের প্রতি সহনশীল আচরণ করার আহ্বান জানিয়ে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মু. শুকুর আলী জানালেন, তাঁর সরকারি বাসার গাছে পাখিদের এই বিচরণে তিনি খুবই আনন্দিত।