বড়গুনি, বড়বাড়িয়া (চিতলমারী, বাগেরহাট) থেকে ফিরে: কেউ ব্যস্ত খেলাধুলায়, কেউবা গানের তালিম নিতে। আবার ক্লাস শুরু হতেই পরিপাটি হয়ে নিমগ্ন পড়াশোনায়। যেন শিশুদের ইচ্ছা স্বাধীন সবই।
ক্লাসের পড়া না হলেও নেই শিক্ষকের বকুনির ভয়। নেই পড়া-লেখার কোন একঘেঁয়েমি। তাই তো ইচ্ছা হলে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছোট্ট এসব শিশুরা মেতে ওঠে হাসি-আনন্দ, খেলাধুলা আর নাচ-গানে।
এ যেন বিদ্যালয়ের চিরায়ত ধারণা ছাপিয়ে এটি একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ঠাঁই করে নিয়েছে শিশু শিক্ষার্থীদের মনে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধারণা পাল্টে দেওয়া অন্যরকম এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কোনো সরকারি বা এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় নয়।
বলছি বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা “আদর্শ শিশু নিকেতন” নামের অনন্য এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা।
এই আদর্শ শিশু নিকেতন থেকে শিক্ষার আলো বিলিয়ে চলেছেন আলোর দিশারী হয়ে ওঠা শিক্ষানুরাগী মুন্সী সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি।
প্রত্যন্ত অজপাড়া গায়ের অবহেলিত দরিদ্র শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ও পড়াশুনায় আগ্রহ বাড়াতে ২০১০ সাল থেকে ব্যতিক্রম এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি।
বিদ্যালয়টির সবচেয়ে ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য এখানে পড়াশুনা হয় শিশুদের আগ্রহ অনুযায়ী। নেই প্রচলিত গৎবাঁধা সময়সূচি, শিক্ষকের গাম্ভীর্য ও নিয়মের সাত-পাঁচ। এমনকি, এখানে রয়েছে শিশুদের আবাসিক ব্যবস্থাও। এখানকার সব শিশুরাই নিজেদের রাজ্যের রাজা। শিশুরা এখানে হেসে-খেলে শেখে নিজেদের পাঠ। পাশাপাশি তাদের দেওয়া হয় দেশপ্রেম ও সংস্কৃতির ধারণা।
এ অঞ্চলের আলোর দিশারী হয়ে ওঠা ও আদর্শ শিশু নিকেতনের স্বপ্নদ্রষ্টা মুন্সী সাইফুল ইসলাম পেশায় সামান্য একজন পল্লী চিকিৎসক।
সমাজে শিশুদের গৎবাঁধা নিয়মের পড়াশোনা ও জবরদস্তি তাকে ভাবাতো। একান্তে পড়ালেখাকে ছোট্ট শিশুদের কাছে খেলাধুলার মতন আনন্দদায়ক করে তোলার পথ খুঁজে ফিরতেন তিনি। অবশেষে নিজের মধ্যেই খুঁজে পান পথ ও পাথেয়। তার হাতে গড়ে ওঠা আদর্শ শিশু নিকেতন এখন এক আলোকবর্তিকার নাম।
যেভাবে পথচলা শুরু
বাগেরহাট জেলা শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে চিতলমারী উপজেলার বড়বাড়িয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম বড়গুনি। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের প্রধান পেশা কৃষিকাজ।
তখন ২০০০ সাল। সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছেন গোপালগঞ্জের ভাটিয়াপাড়ার গোবরা গ্রামের মো. আতিয়ার রসুল মুন্সির ছেলে মুন্সি সাইফুল ইসলাম। জীবিকার তাগিদে এ সময় পল্লী চিকিৎসক হিসেবে পাশের জেলা বাগেরহাটের এ গ্রামে আসেন তিনি।
গ্রামের দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করেন তিনি। এজন্য তাকে এখানে-সেখানেও যেতে হতো রোজ-রোজ। কাজের মধ্যেই তিনি লক্ষ্য করেন এলাকার অবহেলিত দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তারা স্কুলে যায়না। স্কুলে যেতেও তাদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই।
তখন থেকেই এইসব দরিদ্র শিশুদের মধ্যে সুশিক্ষার আলো ছড়ানোর ভূত পেয়ে বসে তাকে। উপায় নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তিনি।
আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ২০১০ সালে বড়গুনি গ্রামের নিজের ভাড়া করা বাসায় মাত্র ৪ জন শিশুকে নিয়ে শুরু করেন ‘আদর্শ শিশু নিকেতন’ নামে শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
বর্তমান অবস্থা
গত চার বছরে সাইফুল ইসলামের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটির জায়গা পরিবর্তন হয়েছে ৩ বার। তবে তাতে একটু দমে যাননি তিনি। গ্রামের মানুষের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে চলেছে তার কাজ।
অন্যের জমিতে টিনশেডের ঘর বেঁধে চলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম। ৪ জন শিশুকে শুরু করা তার শিশু শ্রেণির বিদ্যালয়টি চার বছরে পেরিয়ে এখন চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত করা হয়েছে। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার বিদ্যালয়য়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন ১২০ জন। রয়েছে তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির ৩০ শিক্ষার্থীর আবাসিক ব্যবস্থাও।
শিশুদের আকর্ষণ
মূলত বিনোদননির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার কারণেই এ বিদ্যালয় পড়তে আগ্রহী শিশুরা। পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি এখানে নৈতিকতার শিক্ষাও দেওয়া হয়।
এছাড়া পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুদের খেলাধুলা, নাচ-গান, অভিনয়-আবৃত্তি, ধর্মীয় আচার-আচরণের নিয়মিত চর্চা হয় এখানে। এখানে পড়তে আসা শিশুদের কাছে শিক্ষকরা শুধু শিক্ষকই নন, তাদের বন্ধু ও অভিভাবকও।
সরজমিনে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা মেলে শিশুদের আনন্দ পাঠের এমন চিত্র।
মহান সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণের মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে শুরু হয়ে দিনের কার্যক্রম। সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে চলে অ্যাসেম্বলি। এরপর শুরু হয় পাঠদান কার্যক্রম।
শিক্ষক বলতে এ বিদ্যালয়ে সাইফুল ইসলাম ছাড়া রয়েছেন তার সহধর্মিণী সাবিনা ইয়াসমিন এবং লোপা বিশ্বাস নামে স্থানীয় এক কলেজ শিক্ষার্থী।
লোপা বিশ্বাস এ বিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি গানের তালিম দেন। তার হাত ধরে বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও এখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে পারে।
এ আদর্শ শিশু নিকতনে পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত গান-বাজনা, শরীর চর্চা, নাটকের প্রদর্শনীসহ সহশিক্ষামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম হয়। যা ইতোমধ্যে বিদ্যালয়টিকে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ও অনুসরণীয় করে তুলেছে।
ব্যতিক্রমী এ বিদ্যালয়ে বাগেরহাট ইনফো ডটকমের আগমন উপলক্ষে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এদিন অভিনয় করে দেখায়, যৌতুক বিরোধী নাটিকা, গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া লাঠিখেলা ও বিভিন্ন সহশিক্ষা আয়োজন।
নাটিকা পরিবেশন শেষে বিদ্যালয়ের চতুর্থ শেণীর ছাত্রী চৈতি খা এর কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাদের এ নাটিকার উদ্যেশ কি? বাগেরহাট ইনফো ডটকমেকে চৈতি বলেন, তাদের এ নাটিকার মূল উদ্যেশ বাল্যবিবাহ সম্পর্কে নিজের এবং গ্রামের মানুষের মাঝে স্বচেতনতা তৈরি।
পড়াশোনা নিয়ে কথা হয় তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সৌরভ, পুজা বিশ্বাস, চতুর্থ শ্রেণির সৌকত, নয়ন, সৌরভসহ আরো কয়েক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। তারা জানায়, কাকুর (সাইফুল ইসলাম) কাছে পড়তে তাদের খুবই ভাল লাগে। তিনি আমাদের অনেক আদর করেন। কখনোই বকাঝকা করেন না। শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করেন। এমনকি রাতে আবাসিক শিশু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঘুমান পর্যন্ত।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকরাও খুশি আদর্শ শিশু নিকেতনে নিজেদের সন্তানের পড়াশোনা ও সহশিক্ষা নিয়ে।
বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র মাইন উদ্দিনের মা আয়সা খাতুন বাগেরহাট ইনফো ডটকমেকে বলেন, ‘আমার দুই ছেলে। ছোট ছেলেটি এই বিদ্যালয়ে পড়ে। বড় ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তবে পড়াশোনা ও আদব-কায়দায় ছোট ছেলেটি বেশি ভালো।’
তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী পুজা বিশ্বাসের মা সুপ্রা বিশ্বাস বাগেরহাট ইনফো ডটকমেকে জানান, তার মেয়ে রাতে এখানে থেকে পড়াশোরা করে। এখানে বাইরের বিদ্যালয় থেকেও ভালো পড়াশোনা হয়। এজন্য তাদের মাসিক মাত্র ৭৫ টাকা করে বেতন দিতে হয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য এই প্রতিষ্ঠান এবং এর প্রধান সাইফুল ইসলাম বিভিন্ন জাতীয় পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন বলে জানান অভিভাবকরা।
বিদ্যালয়ের একমাত্র বেতনভূক্ত শিক্ষিক লোপা বিশ্বাস বাগেরহাট ইনফো ডটকমেকে বলেন, এক বছর হলো আমি এই বিদ্যালয়ে ক্লাস নেই। কাকা আমাকে প্রতি মাসে ১২০০ করে টাকা দেন। আমি টাকার জন্য ক্লাস করাই না। কাকা আমাকে কোনো সম্মানি না দিলেও আমি এই বাচ্চাদের পড়াতে চাই। এই বাচ্চাদের পড়াতে আমার খুব ভালো লাগে।
নিজের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘আদর্শ শিশু নিকেতন ‘বিষয়ে সাইফুল ইসলাম বাগেরহাট ইনফো ডটকমেকে বলেন, ‘পল্লী চিকিৎসক হিসেবে এ এলাকায় আসার পর থেকেই শিক্ষাবঞ্চিত এখানকার শিশুদের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে হতো। এই ইচ্ছা থেকেই ২০১০ সালে স্ত্রীকে নিয়ে শুরু হয় এর কার্যক্রম।’
আস্তে আস্তে এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এখানে পড়তে আসা শিশুরা যেভাবে শিক্ষা গ্রহণে আনন্দ পায় সেভাবেই তাদের দিনের পাঠ্যদান কার্যক্রম চলে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো শিশুকে শিক্ষা দেওয়া হয়না।
আলো দিশারী এই মানুষটি জানান, তার বিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো যায়গা না থাকায় কিছুটা সমস্যা হয়। বর্তমানে স্থানীয় এক ব্যক্তি এখানে তাকে বিদ্যালয়টি চালানোর জায়গা করে দিয়েছেন।
বিদ্যালয়টিকে এগিয়ে নিতে নিজে কোনো সাহায্য চান না উল্লেখ করে সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি কোনো সাহায্য চাইনা। এই ছেলেমেয়েরা খুবই দরিদ্র। প্রাথমিকের মতো এদের জন্য উপবৃত্তি আর স্কুলের জায়গার একটা ব্যবস্থা করে দিলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।
শিশুদের অভিভাবকদের কাছ থেকে সম্মানি হিসাবে পাওয়া সামান্য অর্থ আর পল্লী চিকিৎসক হিসেবে যা আয় হয় তা দিয়েই এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার এবং বিদ্যালয় চলে বলে বাগেরহাট ইনফোকে জানান তিনি।
সাইফুল ইসলাম আরো জানান, তার ইচ্ছা আগামী বছর থেকে বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্তু চালু করবেন।
কথা বলার একপর্যায়ে আবেগাপ্লুত সাইফুল ইসলাম বলেন, একসময় সারা বাংলাদেশে প্রথম হবে তার শিক্ষার্থীরা। আর বড় হয়ে তার ছাত্র-ছাত্রীরা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবে।
বিদ্যালয়টি নিয়ে আশার কথা বললেন চিতলমারী উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোজাফফর হোসেনও।
বাগেরহাট ইনফো ডটকমেকে তিনি বলেন, মুন্সী সাইফুল ইসলাম সাহেবের ওই বিদ্যালয়ের কথা আমারা জানি। বিদ্যালয়টি গত দুই তিন বছর উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিদ্যালয়টি অন্যান্য ক্ষেত্রেও খুব ভালো।
এই শিক্ষা কর্মকর্তা আরো জানান, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ সব অনুষ্ঠানে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথম, দ্বিতীয় হয়।
বিদ্যালয়টিকে উপজেলা শিক্ষা অফিসের পক্ষ থেকে পাঠ্যবই, শিক্ষা উপকরণ ও প্রশ্নপত্র দিয়ে সহায়তা করা হয় জানিয়ে আগামীতেও সব ধরণের সহায়তা করা হবে বলে জানান শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোজাফফর হোসেন।
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ :: অলীপ ঘটক ও ইনজামামুল হক,
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।
এসআই হক–নিউজরুম এডিটর/বিআই