সম্ভাবনাময় বাগেরহাট জেলায় আছে ঐতিহাসিক ষাটগুম্বজ মসজিদ, হযরত খানজাহান (রহ:) এর মাজার, সুন্দরবনসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। আছে মংলা সমুদ্রবন্দর, ইপিজেড। অপেক্ষায় আছে রেল যোগাযোগ আর নির্মাণাধীন এ অঞ্চলের যোগাযোগের দুয়ার পদ্মা সেতু।
এসব মিলিয়ে আগামী দিনে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ জেলা হবে বাগেরহাট।
জেলা হিসাবে তথ্য প্রযুক্তি, শিক্ষাসহ বিভিন্ন খাতে অগ্রগতি, সাফল্য এবং আগামী দিনের বাগেরহাট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমকে এমন সম্ভাবনার কথা বললেন বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মু. শুকুর আলী।
তিনি বলেন, অচিরেই বাগেরহাট হবে ডিজিটাল জেলা। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নাগরিক সেবা এখন পৌঁছে যাচ্ছে জনগণের দোরগোড়ায়। বাড়ছে আত্ম কর্মসংস্থান, সচেতনতা, জনগণের ক্ষমতায়ন। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, আগামীর সম্ভাবনা।
‘ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র (UISC) বর্তমানে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (UDC) এবং জেলা ই-সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে সারাদেশের মতো বাগেরহাটের পৌরসভা, ইউনিয়নসহ সকল পর্যায়ের জনগণের কাছে অতিদ্রুত সরকারি সব সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায়েই সাধারণ জনগণ ইউডিসির বিভিন্ন তথ্য প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ফটোকপি, কম্পিউটার কম্পোজ, জন্মনিবন্ধন, ভিডিও কলিং, মোবাইল ব্যাংকিংসহ নানাবিধ সেবা পাচ্ছেন।’
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাগেরহাটের ইউনিয়ন পর্যায়ের চেয়ারম্যন, সচিবসহ ইউনিয়ন পরিষদের অনান্য কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে একটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
চলতি বছর ইউডিসি এবং ডিজিটাল সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে খুলনা বিভাগ দেশের প্রথম হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, খুলনা বিভাগে বাগেরহাটের অবস্থান তৃতীয়। বর্তমানে ছেলে-মেয়েদের আইটি-এর (তথ্য প্রযুক্তি) প্রতি আগ্রহ অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে ডিগ্রি এবং অনার্স পাশ করা যেসব শিক্ষার্থীরা ইউনিয়ন পর্যায়ে উদ্যোক্তা হয়ে এসব ই-সেন্টার পরিচালনা করছে তাদের আগ্রহ এবং আইটির প্রতি উৎসাহেই এই সাফল্য।
মু. শুকুর আলী বলেন, সরকার চাইছে ইউনিয়ন পর্যায়ের এ সেবা কেন্দ্রগুলোকে ট্রেনিং সেন্টারে রূপান্তর করতে। আর ইতোমধ্যে বাগেরহাটে এ কাজ শুরু হয়ে গেছে। এর মাধ্যমে সেবা প্রদানের পাশাপাশি এসব কেন্দ্র তাদের এলাকায় প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল গড়ে তুলবে। যার মাধ্যমে আরো গতিশীল হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম।
বর্তমানে বাগেরহাটে প্রতিদিন গড়ে ৩২২ জন জেলা ই-সেবা কেন্দ্র থেকে অনলাইনে বিভিন্ন সরকারি সেবা গ্রহণ করছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, বাগেরহাট ডিসি অফিসের ৫টি শাখার কাজ এখন পুরোপুরি অনলাইনের মাধ্যমে হয়।
একইসঙ্গে জেলা প্রশাসনের প্রায় ৫০ ভাগ কাজ এখন কম্পিউটার এবং অনলাইনের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। আস্তে আস্তে এ ধারাকে ১০০ ভাগ করতে চান বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
দেশের অন্যান্য জেলার মতো বাগেরহাট জেলা সম্পর্কে সকল তথ্য এবং সরকারি সেবা পেতে যে কেউ এখন ঘরে বসে অনলাইনে www.bagerhat.gov.bd -তে ভিজিট করে কাঙ্খিত বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কাজ ও সেবা পেতে পারেন।
তিনি জানান, চলতি বছরের মধ্যে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের পুরো চত্বরকেই ওয়াইফাই (W-iF)জোন করা হবে। যাতে সবাই এই এলাকায় বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। পাশাপাশি আগামীতে উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়েও এমন সেবা চালু করা হবে। সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই মংলা পৌর এলাকায় প্রায় ৪টি স্থান ওয়াইফাই জোন করা হয়েছে। বাগেরহাট পৌরসভার সঙ্গে কথা হচ্ছে, আগামীতে এ ধরনের আরো কয়েকটি এলাকা তৈরির জন্য।
তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাবার এমন নানা সম্ভাবনার কথার মাঝেই বাগেরহাটের মাদকাসক্তি, আত্মহত্যা, বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়েও কথা হয়।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্যতার কারণে অনেক অভিভাবক তাদের মেয়েকে বাল্যবিবাহ দিতে আগ্রহী হন। এ প্রেক্ষিতে সরকার থেকে সমাজসেবা এবং মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাছাইকৃত বাল্যবিবাহ ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে এবং যেন বাল্যবিবাহ না দেয় এজন্য মাসে ২ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এনজিও এবং সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করছে।
মাদকাসক্তি, আত্মহত্যা প্রবণতা সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ধরনের প্রবনতা কেন? শুধু বইয়ের শিক্ষা নয়, এক্ষেত্রে দরকার জীবন ও মানবিক মূল্যোবোধের শিক্ষা, নিজের প্রতি ভালোবাসা। তাই জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় তিনি এ বিষয়ে শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অনেকক্ষেত্রে শিক্ষকদের মাধ্যমে ছেলে-মেয়েরা এমন ভয়ানক পথ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবে।
২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসক হিসাবে বাগেরহাটে যোগ দেন মু. শুকুর আলী। এ সময়ের বিশেষ অগ্রগতির দিক সম্পর্কে তিনি বলেন- তথ্য প্রযুক্তি, শিক্ষা, কৃষি, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, ভেজাল এবং বিষমুক্ত খাবারসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাগেরহাটের সাফল্য অনেক বেড়েছে। যার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে এসব ক্ষেত্রে অনুকরণীয় হতে পারে বাগেরহাট।
তিনি জানান, বাগেরহাটের ৫০১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৩৩৮টিতে ডিজিটাল ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠার জন্য ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতি উপজেলায় ৩টি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়েও দেওয়া হয়েছে এসব উপকরণ। বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুরু করেছে তাদের ডিজিটাল ক্লাসরুমে পাঠদান। যাতে শিক্ষার্থীরা আরো বেশি আগ্রহী হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের এসব আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন সবাইকে ইংরেজি জ্ঞান বাড়াতে হবে। তারা এখন গ্লোবাল ভিলেজের নাগরিক। তাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে সারাবিশ্বের সঙ্গে। তাই বাংলার পাশাপাশি ভালো ইংরেজি জ্ঞান থাকা দরকার।
কৃষিক্ষেত্রে বাগেরহাটের সাফল্য অনান্য জেলার জন্য অনুকরণীয় হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মৎস্য এবং চিংড়ির জন্য বাগেরহাট এমনিতেই বিখ্যাত। বর্তমানে এখানে মাছ চাষের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে সবজি চাষ হচ্ছে। যা ঘেরপ্রধান দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। একইসঙ্গে সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির উত্তরণ ঘটছে।
বাগেরহাটের উন্নয়ন কাজে স্থানীয় ইউনিয়ন ও উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে ভাল সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন জেলা প্রশাসক।
তবে বাগেরহাটের প্রধান সমস্যা নদী-খাল ভরাট হয়ে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা। এ সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, মংলা এবং রামপালের ৩২টি ছোট বড় নদী-খাল খননের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। অর্থ ছাড় পেলে আগামী অক্টোবর থেকেই শুরু হবে কাজ।
পাশাপাশি এতো সম্ভাবনার পরেও এখানে উদ্যোক্তা সমস্যাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে জেলা প্রশাসক।
তিনি বলেন, জেলায় বনবিভাগ সুন্দরবন থেকে কেবল মাছ শিকার, গোলপাতা এবং মধু আহরণের অনুমতি দেয়। তবে এই অনুমতি নিয়ে তার বন ধ্বংস করছে। অনেকেই বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে, নষ্ট করছে বায়োডায়ভারসিটি। কমে যাচ্ছে মাছের উৎপাদন এবং প্রজনন। গোলপাতা সংগ্রহ করতে গিয়ে বনের অনান্য বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে। সবমিলে এ খাত থেকে সরকারের বছরে ৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হলেও ক্ষতি হচ্ছে ২০০ কোটি টাকার বেশি। আর এর মাঝে বড় আয় করে দস্যুরা।
গত জুনে সুন্দরবনের সব ধরনের সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চাই সুন্দরবন কেবলমাত্র ইকো-টুরিজমের ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে উঠুক। এতে করে এ খাতে যেমন ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে, তেমনি সুন্দরবনের উপর নির্ভর জনগোষ্ঠীরও কর্মসংস্থান হবে।
পাশাপাশি প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র রক্ষা, সাগর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমের নদ-নদী ও খাল-বিলে মাছের উৎপাদনও বাড়বে। এ বিষয়ে আগামী সভায় কার্যকর পদক্ষেপ আসতে পারে।
একে এ অঞ্চলের (সুন্দরবন, সাগর ও বন সংলগ্ন এলাকা) দস্যু সমস্যারও এক চমৎকার সমাধান উল্লেখ করেন মু: শুকুর আলী বলেন, জেলে, বাওয়াল বা মৌয়ালদের চাঁদায় চলে দস্যুদের কার্যক্রম। প্রাথমিকভাবে অন্তত ১০ বছরের জন্য সুন্দরবনের অর্থনৈতিক সম্পদ আহরণ বন্ধ করা গেলে এমনিতেই নিয়ন্ত্রণ হয়ে যাবে দস্যুতা। কারণ মানুষ সুন্দরবনে না গেলে দস্যুরা শুধু শুধু বাঘ, কুমিরের কামড় খেতে বনে থাকবে না।
আগামী দিনে বাগেরহাটের অগ্রগতি নিয়ে তিনি বলেন, শুধু সুন্দরবন নয়, পুরো বাগেরহাট জেলাই হতে পারে ইকো-টুরিজমের এক পরিচ্ছন্ন নগরী। ইতোমধ্যে এডিবি’র সহায়তায় ষাটগুম্বজ মসজিদ এবং মসজিদ সংলগ্ন দিঘীটিকে ঘিরে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে মসজিদ সংলগ্ন দিঘীটিকে ঘিরে একটি মনোরম বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। যেখানে থাকছে ইকো-টুরিজমকে প্রাধান্য দিয়ে সব সুযোগ-সুবিধা।
মু: শুকুর আলী বলেন, পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। মংলা সমুদ্র বন্দরও এখন বেশ ভাল অবস্থানে। মংলা-ঘষিয়াখালি চ্যানেলে চলছে খনন কাজ। যা শেষ হলে বন্দরে আরো বড় বড় জাহাজ আসতে পরবে।
শুরু হচ্ছে রেলওয়ের জন্য জমি অধিগ্রহণ। হযরত খানজাহান আলী (র:) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর চালু হলে পাল্টে যাবে বাগেহরাটের চিত্র। ব্যাবসা-বানিজ্য, শিল্প-কারখানা, বিনোদন, টুরিজম সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা সব মিলে বাগেরহাট হবে বিনিয়োগের কেন্দ্র বিন্দু। দেশের শ্রেষ্ট জেলা।
সূত্র- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম