আইন রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত খুলনার হরিণটানা থানা পুলিশেরর উপ-পরিদর্শক (এসআই) আলমগীর যেন আইন লঙ্ঘনকেই অবশ্যকর্তব্য বলে মনে করেন।
চাঁদাবাজি, নির্যাতন, মাদকব্যবসা, হয়রানি ও জিনিসপত্র নিয়ে দাম না দেওয়ার কাজটি তিনি করে যাচ্ছেন লাগামহীনভাবে। আর এসব করে কয়েক বছরের মধ্যে তিনি বনে গেছেন কোটি পতি।
খোদ সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন শত চেষ্টা করেও তাকে বাগে আনতে পারছেন না।
গত ২৮ আগস্ট তার চাঁদাবাজির স্বীকার হয় রেন্ট-এ-কারে চলা বাগেরহাটের একটি গাড়ি। এঘটনা খবর বাগেরহাট ইনফো ডটকমের আছে এলে ওই এসআই এর সম্পার্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করে বাগেরহাট ইনফো।
বিশেষ অনুসন্ধানীতে এসআই আলমগীরের বেপরোয়া চাঁদাবাজির বিভিন্ন তথ্য বেড়িয়ে এসেছে।
গাড়ির কাগজপত্র ও অবৈধ মালামাল দেখার নাম করে প্রতিনিয়ত পকেট ভারি করছে এই এসআই। যা অনেক সময় করছেন দায়িত্বরত অবস্থায় না থেকেও। তার এমন বেপরোয়া লাগামহীন চাঁদাবাজির লাগাম কোনো অবস্থায় টেনে ধরে রাখা যাচ্ছে না। ফলে গাড়ির মালিক ও চালকেরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
অভিযোগ রয়েছে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) হরিণটানা থানা পুলিশ গ্রেফতার বাণিজ্যে অন্যান্য ৭ থানাকে হার মানিয়েছে। যার কারণে লোভনীয় থানা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এটি। অহেতুক আর অযথা রাস্তার মানুষকে আটক করে থানায় নিয়ে বিভিন্নভাবে অবৈধ অর্থ লুফে নিচ্ছেন ওই থানার কয়েকজন এসআই এমন অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এছাড়া মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তারা নিয়মিত মাসোহারা তুলছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নির্দেশও উপেক্ষিত ওই থানায়। দেশব্যাপী যখন সিভিল ড্রেসের পুলিশের ধড়-পাকড় নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন মন্ত্রনালয়ের সেই আইন মানছেন না এ থানার পুলিশরা।
সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এ থানা পুলিশের কর্মকান্ড নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন এসআই আলমগীর। ধান্ধার আর মাসোয়ারা আদায়ের জন্য তার আপন ভাই সুমনকে নিয়ে এসেছেন গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি থেকে। সুমন পুলিশে চাকুরী না করেও যথারীতি ভাইয়ের সাথে রাস্তায় গাড়ী চেকিং, মানুষ চেকিং করেন। সাধারণ মানুষের মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার মোবাইল চেকিং এর মাধ্যমে লুফে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
২৮ আগস্ট এই এসআই আলমগীরের চাঁদাবাজির স্বীকার হয়েছেন বাগেরহাটের এক রেন্ট-এ-কারের চালকসহ যাত্রীরা। দিতে হয়েছে তাদের মোটা অংকের চাঁদা।
গাড়ির চালক রাজিব বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, ২৮ আগস্ট বাগেরহাট শহরের ইউনিক ফার্মেসির মালিক শিব দাসকে নিয়ে তার বোনের বাড়ি যশোর ঝিকরগাছা যান। যেখান থেকে ফেরার পথে রাত আনুমনিক ৩টার দিকে খুলনার সোনাডাঙ্গা বাইপাস সড়ক হয়ে রূপসা ব্রিজের দিকে আসছিলেন। এসময় সাদা পোশাকে ৬/৭ ব্যক্তি ৩/৪টি মটরসাইকেলে তাদের সিগনাল দেয়।
সন্দেহ হওয়ায় তিনি গাড়ি না থামিয়ে চালিয়ে যান। পরে খুলনা জিরো পয়েন্ট এলে পুলিশ তাদের সিগলান দেয়। এসময় গড়ি থামালে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানতে চান আপনাদের পেছনে থামতে সিগলান দেওয়া হয়েছিল কিনা।
তখন চালক স্বীকার করে বলেন পুলিশ বা কোন বাহিনীর পোশাক না থাকায় তিনি গাড়ি থামননি। পুলিশ সদস্যরা স্যার আসছেন বলে অপেক্ষা করতে বলেন।
এর কিছু ক্ষনের মধ্যে মটর সাইকেলে এসআই আলমগীর সেখানে হাজির হন এবং গাড়িসহ তাদের থানায় নিয়ে যান। এর পর তাদের কাছে ইয়াবা আছে বলে তাদের এবং গাড়ি তল্লাশি করেন। এসময় ওষুধের দোকানের মালিক শিব দাস এর কাছে একটি ব্যাংকের চেক পেয়ে এসআই আলমগীর বলেন, এই টাকা দিয়ে তোরা ইয়াবা কিনেছিস, ইয়াবা কই বল। কিন্তু কোন কিছুই না পেয়ে ওই এসআই রাতে থানায় তাদের রেখে চলে যায়।
পর দিন সকালে এসে চালক রাজিবকে চুকনগর ও খুলনা বাইপাস সড়কসহ কয়েকটি স্থানে নিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে ভয় ভীতি দিয়ে জানতে চায় কোথায় ইয়াবা আছে। এসময় ওই এসআই তাকে হত্যারও হুমকি দেয় বলে অভিযোগ করেন চালক রাজিব।
পরে তাকে থানায় নিয়ে আসলে তিনি দেখেন তার প্রাইভেট কারের যাত্রী আব্দুর রব, রাজিব, শিব দাস ছাড়া পেয়েছেন। পরে জানতে পারেন ৩০ হাজার টাকার বিনিময় তাদের পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। ওই যাত্রীরা চালক রাজিবের জন্য ৭ হাজার টাকা দিলে পুুলিশ তাকে ছেড়ে দেয়। তবে ভাড়ায় (রেন্ট-এ-কার) যে প্রাইভেটটি (চট্ট মেট্রো- ১১ ০১৭৮) তিনি চালাতেন সেই গাড়িটি পুলিশ থানায় আটকে রাখে।
গাড়িটি ছাড়াতে এসআই আলমগীর এখন ৪০ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে শনিবার গাড়িটি ছেড়ে দেন।
গাড়িটির মালিক পক্ষের এক নিকট আত্মিয় জানান, এই টাকা নিয়েছেন ওসি নিজে।
এছাড়া কিছুদিন আগে একটি মোটর সাইকেলের পার্স, ইঞ্জিন চুরি করে নিজের রেজিষ্ট্রেশন বিহীন মোটর সাইকেল (যে তার সোর্স চালায়) এ লাগিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন এসআই আলগমীর। পরবর্তীতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার চাপে আবারো ওই যন্ত্রাংশ লাগিয়ে দিতে বাধ্য হন তিনি।
হরিণটানা এলাকায় কেউই নিরাপদ নয় ওই এসআই আলমগীরের জন্য। মোবাইলের সীম থেকে শুরু করে প্রাইভেট কার পর্যন্ত আটকানোর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এছাড়া এসআই আলমগীর নিজেই মাদকাসক্ত হওয়ায় সম্প্রতি তার স্ত্রী তাকে দরজা বন্ধ করে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করায় তিনি ২/৩দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। পরবর্তীতে কেএমপির একজন উর্ব্ধতন কর্তা আলমগীর ও তার স্ত্রীর শালিসি করেছেন। শালিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৬ মাস আলমগীর তার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে পারবে না বলে পুলিশের সংশ্লিষ্ট থানার এক কর্তা জানিয়েছেন।
একটি বিশেষ সূত্রে জানা যায়, অবৈধ উপার্জিত অর্থ স্ত্রীর একাউন্টে রাখায় এবং মামা শশুরের নামে জমি কিনেও বিপাকে রয়েছেন এসআই আলমগীর।
অপরদিকে গত মাসে থানার খালাসী মোড় এলাকা থেকে ৪ বোতল ফেন্সিডিলসহ জনৈক ব্যক্তিকে আটক করে ওই থানার এএসআই রিপন মোল্লা। আটক করার পরে দরদাম করে ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন মাদক বিক্রেতাকে।
এছাড়া নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায়, ভিক্ষুকও নিরাপদ নয় এ থানা এলাকায়। সম্প্রতি ভারত থেকে ভিক্ষা করে টাইঙ্গাইলের আব্বাস ও ইউনুস দেশে ফিরে আসেন। হরিনটানা এলাকায় পৌছালে থানার ওসির সাবেক ড্রাইভার খবির ওই ভিক্ষুকদের ভিক্ষা করে উপার্জিত ৮০ হাজার টাকা থেকে ৪২ হাজার টাকা রেখে ভিক্ষুকদের ছেড়ে দেন।
অশ্রুভেজা চোখে ভিক্ষুক আব্বাস ও ইউনুস জানান, ২ বছর ভারতে ভিক্ষা করে, রাস্তা ঝাড়–দিয়ে ৮০ হাজার টাকা উপার্জন করে দেশে ফিরছিলাম কিন্তু পুলিশ আমাদের হরিনটানা থানায় নিয়ে সবটাকা নিয়ে নেয় পরে কাকুতি মিনতি করার পরে ৩৮ হাজার টাকা ফেরৎ দেয়।
অপর এক সুত্র জানায়, হরিণটানা এলাকায় যাত্রী হয়রানীর অভিযোগ রয়েছে, এক রিক্সা বা ইজিবাইকে জোড়া ছেলে মেয়েকে পেলে তাদের আর রক্ষা থাকে না। রাস্তায় বিভিন্ন ভাবে তাদের নাজেহাল ও অবৈধ টাকা লুফে নেয় ওই থানার পুলিশরা।
শনিবার রূপসার কলেজ ছাত্র হাবিব তার বন্ধু বান্ধবীকে নিয়ে জিরো পয়েন্ট ঘুরতে গেলে কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের মটরসাইকেল আটকে চাঁদা দাবি করেন এসআই আলমগীর। পরে তাদের কাছে টাকা না থাকায় সিগারেট দিয়ে রক্ষা পেতে হয়।
এছাড়া মহানগর ডিবি পুলিশ কর্মরত থাকা অবস্থায় আলমগীর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ব্যাপক চাঁদাবাজি করেছেন। ব্যবসায়ীরা ২০১৩ সালে এসআই আলমগীরের শাস্তির দাবি জানিয়ে পুলিশ হেড কোয়ার্টার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ও কেএমপি কমিশনার বরাবর আবেদন করেছেন।
আবেদনে ব্যবসায়ীরা বাগেরহাট ইনফোকে জানান, এসআই আলমগীর পাসপোর্ট আইনের কথা বলে ব্যবসায়ীদের প্রথমে মামলা ও জেলে দেয়ার ভয়ভীতি দেখায়। পরে উৎকোচ আদায়ের পর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে শুধুমাত্র জরিমানা আদায় করে ছেড়ে দেয়। এছাড়া সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় কর্মরত থাকা অবস্থায় বিভিন্ন মাদক পয়েন্ট ও আবাসিক হোটেল থেকে মাসিক মাসোয়ারা আদায়, সোনাডাঙ্গা খোঁড়ার বস্তিতে র্যাবের দুই কর্মকর্তার ওপর হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীদের সাথে সখ্যতা ও ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে এসআই আলমগীরের বিরুদ্ধে।
স্থানীয়দের অভিযোগ উপরি মহলের আশির্বাদে করছে আলমগীর।
এ সম্পর্কে এসআই আলমগীর মোবাইল ফোনে বলেন, এসব অভিযোগ কোথায় শুনেছেন। সামনাসামনি আসেন দেখা করেন। তানা হলে বলেন আমি কোথায় দেখা করবো।
এব্যাপারে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আক্তার হোসেন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আমি ওসি হয়েও ওর সাথে পারিনা। ও আমার ফোনও ধরে না। বেশি বেড়ে গেলে যা হয়।
থানায় বাগেরহাটের এক ব্যক্তির রেন্ট-এ-কার আটকে রাখা প্রসঙ্গে ওসি বলেন, আলমগীর গাড়ি আটকাতে পারে। ছাড়ার দায়িত্ব আমার।