মন্দাভাব, ইমেজ সঙ্কট ও লোকসান কাটিয়ে এখন সম্ভাবনার পথে অগ্রসর হচ্ছে মংলা বন্দর। পাশাপাশি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুনমাত্রা উন্মোচনের সম্ভবনা তৈরি হয়েছে।
অনুসন্ধ্যানে জানাগেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামল ও মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে মংলা বন্দর থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ৯৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার সময় এই বন্দরের লাভ ছিল ১৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। তবে এরপর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসার পর বন্দরটির লোকসান হতে থাকে। বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ঐক্য জোট সরকারের পাঁচ বছরে বন্দরটিতে লোকসান হয় ৩৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ২০০২ সালে পাঁচ কোটি ৫১ লাখ টাকা, ২০০৩ সালে পাঁচ কোটি ৮০ লাখ, ২০০৪ সালে ১১ কোটি ৬১ লাখ, ২০০৫ সালে ৯ কোটি ৩৯ লাখ এবং ২০০৬ সালে ছয় কোটি ১৮ লাখ টাকা লোকসান হয়।
এরপর আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে বন্দরের আয় বাড়ে। দুই বছরে ৪ কোটি ২২ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৮-০৯ অর্থবছর দুই কোটি ৫৭ লাখ, ২০০৯-১০ অর্থবছর দুই কোটি ২৭ লাখ, ২০১০-১১ অর্থবছর ২১ কোটি ৮৩ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছর ৩৪ কোটি ১৪ লাখ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছর ৩০ কোটি ৩৪ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয় বন্দর থেকে।বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রত্যাশা করছেন আরও আধুনিকায়নের মাধ্যমে প্রতি বছরই এ রাজস্ব আয় বাড়বে। আধুনিকায়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে মৃতপ্রায় এ বন্দরকে সচল ও গতিশীল করা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বন্দর উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি কয়েকশ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প নেন বন্দরকে ঘীরে। বিভিন্ন দফতরের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম মংলা বন্দরের মাধ্যমে পরিচালনা করার জন্য নির্দেশ দেন। এর ফলে ৬ বছরে এ বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়।নানা পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বন্দরে জাহাজ নোঙর করার সংখ্যা বেড়েছে। ২০০৭-০৮ অর্থ বছর থেকে বন্দর লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গত ৫ বছরে বন্দরে জাহাজ আসে এক হাজার ২৮৯টি। পণ্য খালাস ও বোঝাই হয় এক কোটি ৩৬ লাখ মেট্রিক টন। কন্টেইনার আমদানি-রফতানি হয় এক লাখ ৬৪ হাজার ৬৯৯টি। রাজস্ব আয় হয় ৬৪৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। বন্দর পরিচালনায় ব্যয় হয় ৪৯৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আর লাভ থাকে ১৫৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
মংলা বন্দরের উন্নয়নে এখনও কয়েকটি প্রকল্প অপেক্ষমাণ রয়েছে। বন্দরের মুরিং এলাকায় ৯ মিটার ড্রাফটে জাহাজ আসা-যাওয়ার পথ তৈরি করতে পশুর চ্যানেলের আউটার বারের ৪৩ লাখ ৫২ হাজার ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের জন্য ১৭৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকার সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। ভারত সরকারের লোন অফ ক্রেডিটের আওতায় মংলা বন্দরের জন্য ১০৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ড্রেজার, একটি টাগ বোট, দুটি হাউজ বোট, পাইপ, ফ্লোটার ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য ২০১৩ সালের ২০ জুলাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পটির কাজ আগামী বছরের জুনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। তাছাড়া নিয়মিত ড্রেজিংয়ের জন্য নিজস্ব একটি ড্রেজার কেনা হয়েছে। আরও একটি কেনার প্রক্রিয়া চলছে। ড্রেজিং কাজগুলো সম্পন্ন হলে মংলা জেটি পর্যন্ত বড় কন্টেইনার জাহাজ আসতে পারবে।
মংলা বন্দরের চেয়ারম্যান কমডোর হাবিবুর রহমান ভূইয়া বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, “মূলত দুটি সমস্যার কারণে মংলা বন্দরের যোগাযোগ ব্যবস্থা আটকে রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পদ্মা সেতু। মাওয়ায় সেতুটি নির্মাণ হলে মংলা বন্দরের চিত্র পাল্টে যাবে। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ সম্পন্ন হলে জাহাজ আগমনের পরিমাণ বাড়বে।”
মংলা বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী (সিওহা) মো. কাওসার আলী বাগেরহাট ইনফো কে বলেন, পশুর চ্যানেলের হারবার এলাকায় ড্রেজিং করার জন্য ১৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। ৩৫ লাখ ১১ হাজার ঘনমিটার মাটি ড্রেজিং কাজ চলছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের ৫০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
এদিকে বন্দর উন্নয়নে মংলায় জ্বালানি তেলের ডিপো স্থাপন, বন্দরে মালামাল ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য আধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ, বন্দর এলাকায় কোষ্টগার্ডের নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা, হারবারিয়া এলাকায় দুটি এবং দিগরাজ নেভাল জেটি সংলগ্ন এলাকায় দুটি বয়া স্থাপন, আউটার ড্রেজিং কাজ সম্পন্ন, বন্দর চ্যানেলের ক্যাপিটাল ড্রেজিং সম্পন্ন, বন্দরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাইলট নিয়োগ, বন্দরে ট্যারিফ বৃদ্ধি, জেটিতে সিসিটিভি সচল রাখা ও আইএসপিএস কোড অনুযায়ী কাস্টম বন্ডেড বাউন্ডারী ওয়াল নির্মাণ, বন্দর এলাকায় ব্যবহারকারীদের অফিস স্থাপন, ড্রাফট সম্পর্কিত তথ্য নৌ-বাহিনীর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের হাইড্রোগ্রাফিক ডিপার্টমেন্টে পাঠানো, আমদানি করা গাড়ি জাহাজ থেকে খালাসের আগে ‘অন বোর্ড সার্ভে’ করা এবং জেটি ইয়ার্ডের চারপাশে ফেলিং দিয়ে গাড়ি সংরক্ষণ, ৮নং শেডে রক্ষিত আমদানিকৃত পচা চাল বিনষ্টকরণ, বন্দর থানা স্থাপন এবং শ্রমিকদের জন্য কল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও অগ্রগতির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায়।
৯০ দশকের শুরুতে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, শ্রমিক অসন্তোষ, মামলা, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, দস্যুতা, পাইলট ও কাষ্টমের হয়রানি, ঘন ঘন ধর্মঘটের কারণে দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মংলা অচল হয়ে পড়ে। তাছাড়া অতীতে সরকারের একচোখা নীতি, ভুল পরিকল্পনা এবং অদূরদর্শিতার কারণে এ সমুদ্র বন্দরটি জৌলুস হারায়। বন্দরের সুনাম নষ্ট হতে থাকে। ব্যবসায়ীরা বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কমতে থাকে বন্দরের রাজস্ব আয়। বন্দরটি লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যার প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে।