বাগেরহাট সদর হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং সরকারি চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র গুলোতে চলছে চরম চিকিৎসক সংকট।
সরকরি হাসপাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলোর অধিক অংশ চিকিৎসকের পদই এখন শুন্য। ফলে ভেঙে পড়েছে গোটা জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক মিলিয়ে মোট চিকিৎসকের পদ রয়েছে ২১২টি। তবে, ডাক্তার না থাকায় এসব পদের অধিক অংশই শুন্য পড়ে আছে।
বাগেরহাট সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায়, জেলার বিভিন্ন স্তরে মোট ২১২টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে চিকিৎসক আছেন মাত্র ৬২ জন।
অর্থাৎ ২১২টি চিকিৎসক পদের ১৫০টিই বর্তমানে শুন্য। যার দরুন মাত্র ৬২ জন চিকিৎসক নিয়ে খুড়িয়ে চলছে এ জেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। তার উপর বিভিন্ন সময় নানা বিধি ট্রেনিং, ছুটি, সরকারি অনুষ্ঠানে অংশগহণসহ বিবিধ কাজে কর্মস্থলে থাকছে না অনেক চিকিৎসক। আর এর ফলে বিভিন্ন সময় জেলার কোন কোন উপজেলা স্বাস্থ্য পমপ্লেক্স হয়ে পড়ছে চিকিৎসক শুন্য। কিম্বা মাত্র একজন ডাকাক্তার দিয়ে কোন রকমে চলছে জোড়া তালির স্বাস্থ্য সেবা।
বুধবার দুপুরে সরজমিনে সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের উপকূলীয় উপজেলা শরণখোলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, ৩১ শয্যা বিশিষ্ট এ হাসপাতালটিতে একমাত্র স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ইউএইচও) ছাড়া অন্য কোনো ডাক্তার নেই। ঈদের ছুটি শেষ হবার পর থেকে এই এক জন মাত্র ডাক্তার দিয়েই চলছে উপজেলাবাসীর স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম।
ফলে প্রতিদিন শত শত রোগী ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। আবর অনেকে চিকিৎসা না নিয়েই ফিরে যাচ্ছেন তার রোগীকে নিয়ে, কিম্বা স্মরণাপন্ন হচ্ছেন এলকার হাঁতুড়ে চিকিৎসকের কাছে।
খোঁজ নিয়ে জান গেছে, শরণখোলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ রয়েছে দু’টি সরকারি সাব সেন্টার ও ১৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক। এতে একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ মোট ১৩ জন ডাক্তার থাকার কথা। কিন্তু সেখানে একমাত্র স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ইউএইচও) ছাড়া অন্য কোনো ডাক্তার নেই বর্তমানে। এছাড়া ১৩ জন স্বাস্থ্য সহকারীর পরও শুন্য পড়ে আছে দির্ঘ্য দিন ধরে।
শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সূত্রে জানা যায়, ৪ বছর ধরে শূণ্য এখানকার ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ানের পদ। এছাড়া ১০জন চিকিৎসকের পদসহ দীর্ঘদিন ধরে শূণ্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ২৬টি পদ। আর ঈদের আগে থেকে শুন্য হয়েছে আরো দুটি চিকিৎস পদ। এক্স-রে মেশিন থাকলেও তা বিকল হয়ে পড়ে আছে বিগত ৪ বছর ঘরে।
হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা আসমা আক্তার জানান, কিছু দিন আগে ডাইরিয়া আক্রান্ত এক রোগী নিয়ে দু’দিন এই হাসপতালে ছিলাম। এখানকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এতোটাই নাজুক যে, টয়লেটেরে মলমূত্র, পানি বাইরে চলে আসে। নোংড়া আর দূর্গন্ধের কারণে হাসপালে সুস্থ মানুষের অসুস্থ হবার উপক্রম।
চিকিৎসা নিতে আসা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের গৃহবধূ হামিদা বেগম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, সর্দি-জ্বর হওয়া তার শিশু সন্তান অলিকে নিয়ে সকাল সাড়ে ৯ টায় এসে দু’ঘণ্টা ধরে বসে আছি। জানতে পারলাম ডাক্তার সাহেব এসে উপরে ওয়ার্ডে রাউন্ডে আছেন। কখন ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে পারব, তা জানি না।
হাসপাতালের পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি উপজেলার খোন্তাকাটা গ্রামের একরাম মুন্সি বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, হাসপাতালের ছাদ ও দেয়ালের পলেস্তারা খঁসে খঁসে পড়ছে। নেই পর্যাপ্ত ফ্যান, লাইট। ফলে বিদ্যুৎ না থাকলে ভুঁতুড়ে বাড়িতে পরিনত হয় হাসপাতালটি।
এব্যাপারে বর্তমানে শরণখোলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একমাত্র চিকিৎসক (স্বাস্থ্য কর্মকর্তা) সুব্রত কুমার সাহা বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জেনারেটর থাকা সত্বেও জ্বালানী সংকটে তা সবসময় ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ডাক্তার না থাকায় তার একারই সবকিছু সামলাতে হচ্ছে। ফলে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
একার পক্ষে এতো বড় জনগোষ্ঠীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব স্বীকার করে বাগেরহাট ইনফোকে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ভঙ্গুর অবকাঠামো মেরামত ও জনবল সংকট নিরসনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে সহসা এ পরিস্থতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
শরণখোলায় কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অগ্রদুত এর পরিচালক মো. আইউব আলী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, পর্যাপ্ত চিকিৎসক এবং চিকিৎসা উপকরণ না কার দরুণ সামান্য কোন অসুস্থতারও সুচিকিৎসা হচ্ছে না একখানে। ফলে একটু কিছু হলেই প্রায় ৬০কিলোমিটার দুরের শহরে ছুটতে হয় এখান কার রোগীদের।
২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় সিডরে সীমানা প্রাচীর (বাউন্ডারী ওয়াল) ভেঙে যাবার পর থেকে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে হাসপাতালটি। আর এসব সংকট নিরসনে কার্যকরি পদক্ষেপ না থাকায় মারাত্মক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে উপজেলার দেড় লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবা।
জেলার চিকিৎসা ব্যবস্থার সার্বিক এ চিত্র নিয়ে বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. মো. বাকির হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষন করে বাগেরহাট ইনফো ডটকম। চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে বাগেরহাট ইনফোকে তিনি বলেন, শরণখোলার বিষয়টি আজ সকালে আমি অবগত হয়েছে। ঈদের ছুটি শেষ করে সেখানে আরো দু’জন চিকিৎসক যোগদানে কথা ছিলো। আগামীকাল নাগাত তারা যোগদিলে পরিস্থিতি কিছুটা সাভাবিক হবে।
আর সরকারি সেবা কেন্দ্র গুলোতে চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি জাতীয় সমস্য উল্লেখ করে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি বলেন, আগামী ৭ তারিখের ভিতর সরকার একটি বড় নিয়োগ দিচ্ছে। এতে দেড়শ না পেলেও বাগেরহাটের জন্য অন্তত্য ১২০-১৩০ জন চিকিৎসক পাওয়া যাবে।
প্রত্যাশা অনুযাই চিকিৎসক পাওয়া গলে চলতি নিয়োগের পর বাগেরহাটের চিকিৎসক সংকটের ৮০ ভাগ নিরসন সম্ভব হবে। এজন্য সংবাদিক, জনপ্রতিনিধসহ সকলের সহযোগীতাও চান তিনি।