৪৩ বছর ধরে স্বামীর ঘরে তালা বন্দি থাকার পর বাগেরহাটে খানকা শরীফের খাদেম কথিত পীর শেখ নুর মোহাম্মদের বাড়ি থেকে তার স্ত্রীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাগেরহাট মডেল থানা পুলিশ এই উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে।
এসময় কথিত ওই পীরের দুই স্ত্রী ও চার সন্তানকেও উদ্ধার করেছে পুলিশ। পর্দার দোহাই দিয়ে নূর মোহাম্মদের তার প্রথম স্ত্রী কুলসুম বেগম (৫৮)কে ৪৩ বছরসহ অন্যদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে ঘরে তালা বন্দি করে রাখা হয়েছিল।
তবে, অভিযান শুরুর আগেই পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যায় ভণ্ড ওই পীর।
ঘরে তালাবদ্ধ রাখায় ৩৫ বছরের অবিবাহিত মেয়েসহ পাঁচ সন্তানকে পর্যন্ত সূর্য্যের মুখ দেখতে দেয়নি পীর দাবিদার নুর মোহাম্মদ।
পীরখ্যাত ওই ব্যক্তির ছেলে বাকিবিল্লাহর অভিযোগের ভিত্তিতে পারিবারিক সুরক্ষা আইন-২০০০ এর ৪ ধারায় বাগেরহাট মডেল থানা পুলিশ দুপুরে বাগেরহাট শহরের সরুই এলাকায় তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তালা ভেঙ্গে উদ্ধার করা হয় প্রথম স্ত্রী কুলসুম বেগম (৫৮), দ্বিতীয় স্ত্রী পারভীন আক্তার (৩৫), প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ফাতেমা আক্তার (৩৫), ছোট স্ত্রীর দুই মেয়ে ও এক ছেলে সালমা আক্তার (১১), নুর জাহান (৬) ও মাহাবুববিল্লাহ (৩) কে।
উদ্ধারের সময়ে নারীদের পরিধানের জন্য শাড়ি, সায়া ও বোরকা না থাকায় পার্শবতী বাড়িগুলোর নারীদের কাপড় দিয়ে তাদের বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসতে সহায়তা করা হয়।
বিয়ের পর থেকে দুই স্ত্রী ও জম্মের পর থেকে সূর্যের আলোর মুখ দেখতে না পাওয়া সন্তানরা উদ্ধারের পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তারা।
উদ্ধারের পর নুর মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী কুলসুম বেগম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, পর্দার নামে বিয়ের পর থেকে ৪৩ বছর ধরে তিনি তালাবদ্ধ ঘরে বন্দি থেকেছেন। ১০ বছর আগে তার পিতা বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার রাজৈর গ্রামের মুন্সী আব্দুল হামিদ মারা গেলে তার স্বামী তাকে দেখতে যেতে দেন নি।
প্রায় প্রতিদিন তাকে ও তার স্বতীন ও ছেলেমেয়েদের মারপিট করত নুর মোহাম্মদ। তালাবদ্ধ থাকার প্রতিবাদ করলে ছেলে-মেয়ে-স্বতীনসহ তাদের উপর নেমে আসত নির্মম শারিরীক ও মানুষিক নির্যাতন বলে জানান তিনি।
সরজমিন ওই ঘরটিতে গিয়ে দেখা যায়, তালাবদ্ধ ঘরটিতে ছিল না কোনো জানালা, কেবল সামনে ও পিছনে ছিল দুটি দরজা।
উদ্ধারকৃতরা জানান, সবসময় তালাবদ্ধ করে রাখা হত। মেজ মেয়েটিকে দু’বছর আগে বাগেরহাট পুলিশ সুপারের মাধ্যমে ছেলে বাকীবিল্লাহ বিয়ে দিলে ছেলের উপর রুষ্ট হন তার স্বামী পীর খ্যাত নূর মোহাম্মদ। বোনকে বিয়ে দেওয়ার অপরাধে ছেলে বাকী বিল্লাহকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় নুর মোহাম্মদ।
একই রকম অভিযোগ করেন নূর মোহাম্মদের দ্বীতিয় স্ত্রী পারভীন আক্তার। তিনি জানান ২২ বছর আগে তার বিয়ে হলেও দু’বছর আগে একবার তিনি কৌশলে পালিয়ে তার পিতা মাও. আব্দুল হামিদের বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার রহমতপুরে আশ্রয় নিলেও তার স্বামী মুরীদদের সহায়তায় ধরে এনে পায়ে শিকল দিয়ে লালসালু’র মত আটকে রাখে।
বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি আরো জানান, জম্মের পর থেকে তার ও তার বড় স্বতীনের সন্তানদেরও একইভাবে আটকে রাখা হত। কোনো আত্মীয়-স্বজন ও বাবার বাড়িতে কখনই যেতে দেননি। এমনকি তার স্বামী একে একে চারটি বিয়ে করলেও বর্তমানে রয়েছে তার দুই স্ত্রী।
উদ্ধার হওয়া মেয়ে ফাতেমা আক্তারের বয়স ৩৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও তাকে বিয়ে দেননি। বিয়ের জন্য কোনো পাত্রকেও দেখাননি।
বাগেরহাট শহরের কলেজ রোডে হাজী আরিফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ও পীরখ্যাত নূর মোহাম্মদের বাড়ির আস্তানা থেকে উদ্ধার হওয়া এই দুই স্ত্রীর ৯ ছেলে ও চার মেয়ে রয়েছে। কোনো মেয়েকেই নুর মোহাম্মদ স্কুল-মাদ্রাসায় লেখাপড়ার সুযোগ দেননি।
উদ্ধারকৃতদের বাগেরহাট মডেল থানায় আনা হলে দুই মা ও ভাই-বোনদের দেখতে সেখানে ছুটে আসেন মামলার বাদী ছেলে বাকিবিল্লাহ, তার ভাই মাসুম বিল্লাহ ও মাহফুজ বিল্লাহ।
তারা তার বাবার বিরুদ্ধে একই রকমের অভিযোগ করে জানান, ইসলাম নারীদের পর্দায় থাকতে বলেছে ঠিকই। তবে তার বাবা নুর মুহাম্মদের মত এমন কঠোর হতে বলেনি। বোনদের লেখাপড়ার কোনো সুযোগ ও বিয়ে না দিয়ে এবং তালাবদ্ধ জানালা বিহীন ঘরে আবদ্ধ রেখে তিনি নিজেই ইসলামী অনুসাশন অমান্য করে তাদের মতে মহাপাপ কাজ করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত এই নুর মোহাম্মদ নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নিজ বাড়িতে মাইক টানিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ওয়াজ-নসিয়ত শুরু করে। খুব সহজেই জুটে যায় কিছু ভক্ত।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় মাইকের উচ্চস্বরে ওয়াজ-নসিয়তের ফলে এলাকার ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটলে প্রায় দুই যুগ আগে প্রতিবেশীরা থানায় অভিযোগ করেন। পুলিশ নুর মোহাম্মদকে উচ্চস্বরে প্রতিদিন মাইক বাজানোর অপরাধে আটক করলে বাড়িতে আর মাইক বাজাবেন না এই অঙ্গীকার দিয়ে ছাড়া পান।
এরপর নুর মোহাম্মদ বাগেরহাট শহরতলীর খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের মেগনীতলা এলাকায় জমি কিনে একটি খানকাহ ও মসজিদ নির্মাণ করেন।
বাগেরহাট মডেল থানার ওসি মো. আলী আজম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, নুর মোহাম্মদের ছেলে বাকীবিল্লাহ ২৬ জুন পুলিশ সুপার বরাবরে লিখিত অভিযোগটি সহকারী পুলিশ সুপার (হেড কোর্য়াটার) সাদিয়া আফরোজ সরেজমিন তদন্ত করে সত্যতা পান।
ওই অভিযোগের ভিত্তিতেই বৃহষ্পতিবার দুপুরে ওই বাড়ির তালা ভেঙ্গে তার স্ত্রী ও সন্তানদের উদ্ধার করা হয়।
এ সময়ে পালিয়ে যায় নুর মোহাম্মদ। নুর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে পারিবারিক সুরক্ষা আইনে বাগেরহাট মডেল থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
আদালত উদ্ধারকৃতদের সমাজ সেবা অধিদপ্তর পরিচালিত বাগেরহাট নিরাপদ আবাসন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন।