সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘লালসালু’র কথা মনে আছে নিশ্চয়? তবে ‘মজিদ’ চরিত্রের ধর্ম ব্যবসায়ীর কথাও মনে থাকবার কথা।
ধর্ম ব্যবসায়ী ‘মজিদে’র ধর্মীয় কুসংষ্কারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেন তার ছোট স্ত্রী ‘জমিলা’। এজন্য ‘জমিলা’কে অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। উপন্যাসের সেই ঘটনা অবশ্য অনেক আগের কথা।
কিন্তু অবক করা কথা হল এখনও আমাদের সমাজে আছে মজিদ রুপী ভন্ড পীর। এমন একজনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে সম্প্রতি সময়ে কয়েক বছর শিকলে বন্দি জীবন যাপন করতে হয় তারই ছোট স্ত্রীর।
স্বামীর অত্যাচর সহ্য করতে না পেরে ঘর ছেড়ে পালায় বাগেরহাটের খানকা শরীফের পীর দাবিকৃত খাদেম শেখ নুর মোহাম্মদের ছোট স্ত্রী পারভীন আকতার। পরে নুর মোহাম্মদ তার মুরীদদের সহযোগিতায় ওই স্ত্রীকে ধরে এনে শিকলে বন্দি করে রাখেন।
তবে এর আগে নুর মোহাম্মদ বিয়ে করেন কুলসুম বেগমকে। তিনি ৪৩ বছর তার সাথে সংসার করছেন। কিন্তু পর্দার দোহাই দিয়ে ৪৩ বছরই তার স্বামী তাকে ঘরে তালা বন্দি করে রাখে।
কুলসুম বেগমের ছেলে বাকি বিল্লাহ তার বাবার এমন কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে দুই মাকে এ অবস্থা থেকে পরিত্রানের জন্য ২৬ জুন বাগেরহাট পুলিশ সুপারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ পেয়ে বাগেরহাট পুলিশ সুপার (এসপি) নিজামুল হক মোল্লা, সহকারী পুলিশ সুপার (বাগেরহাট সদর) সাদিয়া আফরোজ ঘটনাস্থলে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন।
বাকি বিল্লাহর লিখিত অভিযোগে বলেছেন, তার বাবার দুই স্ত্রী। তিনি কখনো তাদের ঘরের বাইরে বের হতে দেন না। সবসময় ঘরের বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখেন। বিভিন্ন সময় তাদের উপর শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন চালান। শরীরে অলংকার তো দূরের কথা প্রয়োজনীয় জিনিসও দেন না। বাইরের কাউকে বাড়ি প্রবেশ করতে দেন না। কোন আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ করতেও দেয় না।
এছাড়া তার বোনদেরও সাথে তাদের দেখা করতে দেন না। ঘরের বাইরে যেতে পারে না। লেখাপড়ার সুযোগ তাদের দেয়া হয় নি। তার বড় বোনের ফতেমা আকতারের বয়স প্রায় ৩৫। তিনি সহ তার আরেক বোন ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। বাবার মত পর্দায় রাখবে এমন ছেলে না পাওয়ায় তার বড় দুই বোনের আজো বিয়ে দেয়া হয় নি।
লিখিত অভিযোগে আরো বলা হয়েছে,তার ছোট মা একবার পালিয়েছিল। পরে তাকে মুরীদের সহযোগিতায় ধরে এনে শিকলে বন্দি করে রাখে। তার বাবার অনেক মুরীদ আছে। এরআগের পুলিশ সুপার বাকি বিল্লাহর এক বোনকে উদ্ধার করে বিয়ে দেয়ার কারণে তার বাবা তার মুরীদদের প্রভাব খাটিয়ে ওই পুলিশ সুপারকে বদলির হুমকি দিয়েছিল। তার বাবা ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে মুরীদের কাছ থেকে টাকা পয়সা আদায় করে থাকে।
বাগেরহাট (সদর) সহকারী পুলিশ সুপার সাদিয়া আফরোজ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, তিনি ২৯ জুন ওই বাড়ি গিয়েছিলেন। বাড়ি ঢুকতে তার চোখে পড়ে একটি ঘরে বসে আছে নুর মোহাম্মদের কয়েক মুরীদ। বাড়িটি দুই রুমের । রুমে কোন জানালা নেই। একরুমে বাতিও নেই। নেই কোন আসবাবপত্র। বাইরে থেকে রুমে তালাবদ্ধ থাকে। রুম দুটি বসবাসের একেবারেই অনুপোযোগী।
সাদিয়া আফরোজকে পেয়ে নুর মোহাম্মদের বড় স্ত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং স্বামীর নির্যাতনে বর্ণনা দেন। বড় স্ত্রী তাকে জানান, সে বিয়ের পর থেকে ৪৩ বছর তালা বন্দি অবস্থায় আছেন।
নুর মোহাম্মদের ছোট স্ত্রীর বরাত দিয়ে তিনি আরো জানান, সে যাবার আগে নুর মোহাম্মদ ছোট স্ত্রীকে হুমকি দিয়ে বলেছে, পুলিশের কাছে কিছু বললে জবাই করে দেবে।
নুর মোহাম্মদের ছেলে বাকি বিল্লাহ সোমবার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, গতকাল পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেয়ায় তার বাবা ক্ষিপ্ত হয়েছেন। তার মা -দের নিকট থেকে তারা কোন স্বীকারোক্তি দেন নি এই মর্মে লিখিত নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
বাকি বিল্লাহ তার বাবার হাত থেকে দুই মা ও বোনদের রক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে নুর মোহাম্মদের বক্তব্য পাওয়া যায় নি। তার মোবইলে ফোন করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেন।
তবে বাগেরহাট পুলিশ সুপার নিজামুল হক মোল্যা জানিয়েছেন, তিনি নুর মোহাম্মদকে ডেকে ছিলেন, সে পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তবে এ সময় ওই ওয়ার্ডের কমিশনার তার পক্ষে কথা বলতে এসেছিল।
বাগেরহাট পুলিশ সুপার আরো বলেন, এটা একটা সামাজিক ব্যাধি। এ থেকে তাদের উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু পুলিশ তাদের উদ্ধার করার পর তাদের দায়িত্ব কে নেবে?