আর এসব দস্যু বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না এই বনের প্রধান আর্কষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ এমন কি কুমিরও। টান দুই সপ্তাহের অভিযানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ ঘুরে এসে এসব বিষয়ে রিপোর্ট তৈরী করেছেন আমাদের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ। আজ পড়ুন তার ধারাবহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্ব।
বয়স কতোইবা হবে! ২৭ অথবা ২৮ বছর। এ বয়সেই তিনি একজন দক্ষ অস্ত্রবাজ। চোখের নিমিষে একটি এইট শ্যুটারগান খণ্ড খণ্ড করে আবার জোড়া লাগিয়ে তাক লাগিয়ে দেন।
রাজু বাহিনীর এই সদস্য এখানে এসেছেন মাস ছয়েক হলো। এরই মধ্যে তার এতো উন্নতি! নিমিষেই হরিণ, শুকর থেকে শুরু করে কুমির অথবা পাখি ফেলে দিতে পারেন। তবে মানুষ মারার সুযোগ এখনো হয়নি তার!
লক্ষীপুরে বাড়ি ছেলেটি এক সময় চট্টগ্রাম ও ঢাকায় বিভিন্ন বায়িং হাউজ ও গার্মেন্টে প্যাটার্ন মাস্টারের কাজ করতেন। তার পরিবারের মানুষও জানেন ছেলে চট্টগ্রামে বড় বেতনে চাকরি করছেন। সেই মতো প্রতিমাসে ২৫/৩০ হাজার করে টাকাও বাড়িতে পাঠান বিকাশ করে।
কিভাবে এখানে এলেন– জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে। তিনি (ছেলেটি) বললেন, আমার এক ভাই সুন্দরবনে মাছের ব্যবসা করতেন বলে জানতাম। তার কাছে সুন্দরবন বেড়াতে আসার আব্দার করি। তিনি আমায় কিছুদিন পর আসতে বলেন। আমি তার কাছে এসে দেখি, কোনো ব্যবসা নয়, তিনি ডাকাত দলের সদস্য। এ দলের মেহমান হিসেবে কিছুদিন থাকার পর আমারও ভালো লাগতে শুরু করে।
এখানকার জীবন একটু অন্য ধরনের! আমি সারাজীবন ওয়েস্টার্ন সিনেমায় যে চরিত্রগুলো দেখেছি, আমার মনে হলো তারা সবাই আমার সামনে। আমি ইচ্ছেমতো অস্ত্র হাতে নিচ্ছি, গুলি করছি। অভিযানে যাচ্ছি, হরিণ শিকার করছি। আবার আয়ও খারাপ না। গত ২ মাসে ৫৬ হাজার টাকা বাড়িতে পাঠিয়েছি। আবার টাকা পাঠানোর সময় হয়ে এসেছে। বর্ষাকালে আয় অনেক বেশি হবে। বেঁচে থাকলে তখন অনেক টাকা বাড়ি পাঠাতে পারবো।
এ ছেলেটির মতো আরো অনেকেই আছেন যারা বেড়াতে এসে ভয়ঙ্কর দস্যুতে পরিণত হয়েছেন। তারা বাড়ির কথা ভাবেন, স্বজনের কথা ভাবেন, টাকা পাঠান। কিন্তু প্রিয়জনের সান্নিধ্য সবার কপালে জোটে না। কেবল সিনিয়র পর্যায়ের দস্যুরাই জঙ্গলে পরিজন আনার অনুমতি পান। বনের গহীনে তৈরি গোলপাতার ঘরে স্বজনদের নিয়ে বড়রা যখন রাত্রি যাপন করেন, জুনিয়ররা তখন পালা করে তাদের পাহারা দেন।
লোকটির বয়স ৪৫ বছর। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা আছে। চাকরি করতেন চট্টগ্রামের এক ফিশিং বোটে। এ বোট নিয়ে মাছ ধরছিলেন সুন্দরবন লাগোয়া বঙ্গোপাসাগরে। এ অবস্থায় তাকে জিম্মি কেরে নিয়ে আসা হয় জঙ্গলে। সেই থেকে আর ফেরা হয়নি। হয়ে গেছেন ডাকাত দলের সদস্য।
চট্টগ্রামে থাকেন তার তিন সন্তানসহ পরিবার। কিছু দিন হলো দলে ভিড়িয়েছেন সৌদি আরব প্রবাসী তার বড় ভায়রাকে। তিনি নিজেও দলের মাঝারি নেতা। সুকানির কাজ করেন। ভায়রাকে দিয়েছেন বাবুর্চির কাজ। ডাকাতির পাশাপাশি দল পরিচালনা ও দলের সবার মন উজ্জীবিত করতে হাসি-তামাশায় ব্যস্ত থাকেন তিনি।
রাজু বাহিনীর বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান ইলিয়াসও এক সময় মহেশ্বরীপাশার মাছ ব্যাবসায়ী যা বক্সের নৌকায় চাকরি করতেন। অল্প বয়সেই ইঞ্জিন মিস্ত্রি হিসেবে নাম ছিল তার। বছর পাঁচেক আগে ইলিয়াসকে জিম্মি করে ধরে নিয়ে আসেন ছোট মিয়াখ্যাত রাজু। এখন সেই ইলিয়াসের হাতেই দলের দায়িত্ব দিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন দলের প্রধান।
সুন্দরবনে ডাকাতি করতে আসা সকল দস্যুদেরই আছে এমন গল্প। তবে সবচেয়ে যে বিষয়টি প্রায় সবার ক্ষেত্রে এক, তাহলো তারা সবাই নানা মামলায় ফেরারি আসামি। জেল বা ফাঁসির হাত থেকে বাঁচতে তারা জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে ডাকাতিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
তবে মানুষগুলো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। নানা ভাবে চেষ্টাও করছেন তারা। কিন্তু ডাঙ্গার মানুষগুলোকে বড় ভয় তাদের।
ডাকাতি ছেড়ে মাস তিনেক হলো ডাঙ্গায় ফিরেছেন এমন একজনের সঙ্গে দেখা করতে রামপালে গেলাম। তার বাড়ি এই রামপালেরই এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেই গ্রামেই দেখা হলো তার সঙ্গে। জানালেন তার বর্তমান অবস্থা।
বললেন, তিন মাস জঙ্গল ছেড়েছি। চার বছরের জঙ্গল জীবন ছেড়ে থাকার নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। একমাত্র মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে নতুন ঘর বেধেছি। কিন্তু স্বাভাবিক জীবনে ফেরা খুব কঠিন। ডাঙ্গার মানুষ ও পরিবেশ খুব কঠিন। তারা শুধু খারাপ কাজে ব্যবহারের ভয় দেখান। না হলে ক্রসফায়ারের ভয়! তবে আমি একটি প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য হওয়ায় কেউ তেমন সুবিধা করতে পারছেন না।
তিনি আরো বলেন, কেই ভালো হওয়ার চেষ্টা করলে সমাজের যেখানে সহায়তা করা উচিত, সেখানে অসুবিধা করেন বেশি। তবু শপথ নিয়েছি যে কয়দিন বাঁচবো, মেয়েটাকে নিয়ে ভালো পথে থাকার চেষ্টা করবো।
তিনি বলেন, ভালো হওয়া কঠিন। রাতে ঘুম আসে না। সারারাত জেগে থাকি। জঙ্গলের প্র্রায় পুরোটাই আমার চেনা ছিল। গাছে উঠে বসে থাকতাম। এমন কোনো অস্ত্র নেই চালাতে পারি না। আমার নিশানা ছিল সবার চেয়ে ভালো। সে নিষিদ্ধ মোহ এখনো আমাকে তাড়ায়।
তার মতো বনে দস্যুতা করা অনেকেই ফিরতে চান সাধারণ জীবনে। এজন্য তারা চান সরকারের কাছে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার নিশ্চয়তা। সাধারণ আইন মতো অস্ত্র সমর্পন ও সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার নিশ্চয়তা।
পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে বসবাসের স্বপ্ন দেখেন বনের এই ভয়ঙ্কর বনদস্যু ও ডাকাতেরা।
রহমান মাসুদ
সুন্দরবন থেকে ফিরে: দুই সপ্তাহের সুন্দরবন ভ্রমন। পুরোটাই নৌকা জীবন। মাঝে ২ রাত হোটেলে এসি ছেড়ে ঘুম। বাকি সময় নৌকার তক্তায় খোলা আকাশের নীচে। রোদ- পূর্ণিমার আলো ভরা জোয়ার, শুকনো ভাটা গহীন জঙ্গলের মধ্যে। ছোট্ট নৌকায় রান্না খাওয়া। রাজহাঁস, মুরগী, চিংড়ি, ভোলা মাছ, কোরাল, কাকঁড়া দিয়ে দিনে দুইবার খাওয়া। খালের লোনা জলে গোসল। সকালে লাল চা আর মুড়ি। একাধিকবার তরমুজ। ডাকাত খুজতে গিয়ে গুলির মুখোমুখি আবার তিনদিন ডাকাতের আতিথিয়েতা।
জিম্মীদের আর লুন্ঠিতদের বোবাকান্নার দীর্ঘশ্বাস। দস্যুতার পেছনের গল্প। ডাকাতের গ্রামে যাওয়া। ডাঙ্গায় ফিরে যাওয়া ডাকাতদের বেচেঁ থাকার লড়াই। সব মিলিয়ে বাংলানউজের জন্য বন দস্যুতা নিয়ে ৭ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিলাম। এবার এতো ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছি লিখতে কষ্ট হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম কি লিখব! হয়ত অভিজ্ঞতার কিছুই উঠে আসেনি। তবু চেষ্টা করেছি।
এই অভিযানে দেখা পেয়েছি কিছু জীবন্ত ফসিলের। দেখেছি ইন্তাজ কাকা আর সৈয়দ আলম মাঝির সাক্ষাত। পাখি পুলিশের যুদ্ধ যেমন দেখেছি, তেমনি মরা কুমির আর হরিণ শিকারের দৃশ্য ও দেখেছি। মাছ ধরতে গিয়ে সাপ ধরা আর ঝাকি জালের নিচে কুমির, তারপর মৌমাছির কামড়, নৌকায় গাছ থেকে গুঁইসাপের লম্ফ। কোনটা রেখে কোনটা যে বলি! বলে রাখি সুন্দরবন মানে কিন্তু কেবল করমজল, কটকা, হিরণ পয়েন্ট না। কেবল বাংলাদেশেই সুন্দরবন ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার..
০১. সুন্দরবনের দস্যু নামা !
০২. দস্যুরা মুক্তিপণ নেয় মোবাইল ব্যাংকিং এ
০৩. অপহরণ বানিজ্যে বন্দী বনজীবী
০৪. সুন্দরবনে প্রশাসনের সহায়তায় দস্যুতা!
০৫. দস্যু বাহিনীর সন্ধানে সুন্দরবন
০৬. ডাকাতি নয়, ব্যবসা- দাবী দস্যুদের
০৭. জিম্মিদের বোবা কান্নায় ভারি সুন্দরবনের নোনা পরিবেশ