সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় ডাকাত (দস্যু) বাহিনীর নাম ‘রাজু বাহিনী’। বাহিনী প্রধান রাজু বর্তমানে ভারতে পলাতক থাকলেও দেশে তার দস্যুতার দায়িত্ব আছে ভাগ করে দেওয়া।
দলের নেতৃত্বে থাকলেও দেশে রাজুর দস্যুতার দায়িত্ব ভাগ করা তার তিন সহকর্মী ইলিয়াস, রফিক এবং জাহাঙ্গীরকে। দলের ব্যবস্থাপনার কাজ মারুফের। পুরো সুন্দরবনে রাজত্ব করা রাজু বাহিনীর অবস্থান ভয়ঙ্কর শিপসা নদীর পাড়ে খুলনা রেঞ্জের গহীন জঙ্গলে।
র্যাব-৮ এর শীর্ষ জলদস্যুর তালিকার ১ নম্বরে মারুফ, ২ নম্বরে ইলিয়াস এবং ৩ নম্বরে আছে জাহাঙ্গীরের নাম।
মংলা পৌঁছেই চেষ্টা করছি রাজু বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের। কিন্তু তিন দিন ধরে জঙ্গলের বিভিন্ন গহীনে গেলেও যোগাযোগ স্থাপন ও তাদের আস্থায় আনা সম্ভব হচ্ছিল না।
অবশেষে চতুর্থ দিনে স্থানীয় এক সাংবাদিকের মাধ্যমে ভারতে থাকা রাজুর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হলো চাঁদপাই রেঞ্জের জোংড়া ফরেস্ট ফাঁড়িতে বসেই। নিশানা পাওয়া গেল, কোথায় গেলে দেখা পাওয়া যাবে সে ঠিকানারও। গন্তব্যে পৌঁছানোর রাস্তাও বাতলালেন এই দস্যু সম্রাট।
আমরা বোট ছাড়লাম জোংড়া থেকে। বেলা তখন তিনটার কাছাকাছি। গোনের (ভরা পূর্ণিমায় মাছ ধরার মৌসুম) সময় হওয়ায় বনে জেলেদের আনাগোনা বেশি। সেই সঙ্গে জিম্মির খোঁজে দস্যুদের ব্যস্ততাও চেখে পড়ার মতো।
জোংড়া ভারানী দিয়ে এগিয়েই ছোট খাল দিয়ে আড়াআড়ি যাওয়ার চেষ্টা আমাদের। এ ছোট খালের নাম চিপার ভারানী। ভাটার সময় এ খাল দিয়ে যেতে গিয়ে দিতে হলো বড় ধরনের খেসারত। মরা সুন্দরীর গোড়ায় লেগে ভেঙ্গে গেল নৌকার পাখা। অগত্যা পিছু হটা। নৌকার চার মাঝি নৌকা ঠেলে নিয়ে চললেন পেছনে। সামনেই বাঘ পার হয়ে যাওয়ার পায়ের ছাপ।
এ অবস্থায় বড় খালে এসে আবার নৌকা বেয়ে জোংড়া ফাঁড়িতে। ততক্ষণে সন্ধ্যা।
চারদিকে বন মোরগের আকাশ ফাটানো চিৎকার। জোংড়া খালকে বলা হয় কুমিরের খামার। বন বিভাগের নৌকায় মংলায় পাঠানো হলো ভেঙ্গে যাওয়া পাখা। গভীর রাতে রাজহাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে পূর্ণিমার জোয়ারে আবার যাত্রা শুরু চিপার ভারানী দিয়ে। তবে এবার সতর্ক।
কিছদূর যেতেই প্রথম অঘটন। হেলে পড়া গাছ থেকে আস্ত গুঁইসাপ পড়ল নৌকায়। ঝপ করে নৌকা থেকে সে পানিতে চলেও গেল। মাঝিসহ আমাদের নৌকার যাত্রী মোট ১১ জন।
ঝাপসী খালের মুখে আসতেই ৪/৫টি নৌকায় আলো ও চিৎকার। দুর থেকে পরিচয় জানতে চাইলো আমাদের। এরই ফাঁকে এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি। ৪/৫ জন জেলে নৌকা থেকে নেমে গেলেন ডাঙ্গায়। দস্যুরা বন থেকেই কথা বললেন আমাদের সাথে। জেলেদের দিয়ে ভাত রাধিয়ে না খেয়েই চলে গেলেন তারা। এ দলটি সুন্দরবনের একটি খুচরা দস্যু বাহিনী (খলিল বাহিনী)। যার দলনেতা জনৈক খলিল।
সাংবাদিক পরিচয় জেনেও তারা প্রশাসনের লোক ভেবে জঙ্গল দিয়ে হেঁটে চলে গেলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহের কথা জাননোয় ওই দলের নেতা খলিল বলে গেলেন, ‘এখানে থাকলে গোলাগুলি করা লাগতে পারে’!
রাত তখন আড়াইটা। এ খালেই জেলেদের সঙ্গে রাত কাটল আমাদের।
ভোর ৫টায় আমাদের বোট চলতে শুরু করল অজানা গন্তব্যে। ঝাপসী নদী থেকে মরা পশুর, সেখান থেকে ভদ্রা হয়ে মাংকির ভারানী ঘুরে শিপসা নদীর উত্তাল ঢেউ।
বেলা আড়াইটায় ট্রলার থামলো চাঁদাচাই ফরেস্ট ফাঁড়ি। সেখানেই পরিচয় ফাঁড়ির ইনচার্জ মোস্তফা কামালের সঙ্গে (সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজের বড় ভাই)। এ ফাঁড়ির পুকুরে গোসল সারতেই টেলিফোন বেজে উঠল। আমাদের ট্রলার চালাতে হবে সমুদ্র বরাবর। যেতে যেতে দেখা হবে রাজু বাহিনীর সঙ্গে। ওদের সংকেতেই দিশা পাবে আমাদের নৌকা।
আকাশে কালো মেঘ। উত্তাল ভয়ঙ্কর শিপসা। আমাদের ছোট নৌকা তার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে সোজা দক্ষিণে। চারপাশেই একই রকমের ছোট-বড় খাল। এ অঞ্চলের সুন্দরবনের চেহারা পূবের বাদা থেকে আলাদা। মাঝে মাঝে কিছু কাঁকড়া, কেওড়া ও পশুর থাকলেও গরানই এ বনের মূল বৃক্ষ। সেই সঙ্গে প্রচুর গেওয়া। তবে দেখা নেই সুন্দরীর।
কিছুদূর যেতেই চোখ আটকে গেল পাড়ে। নৌকা ঘুরিয়ে সামনে গিয়ে দেখি, ১২/১৪ ফুট লম্বা মরা কুমির চিৎ হয়ে পড়ে আছে। চার-পাঁচটি গুইসাপ মাত্র পেট ছিদ্র করেছে কুমিরটির। ছবি নিয়ে আবারো সামনে যাত্রা।
সন্ধা ছুঁইছুঁই। কালো মেঘ ভীষণ আকার ধারণ করেছে। জোরে বাতাস শুরু হতেই উত্তাল ঢেউয়ের হাত থেকে বাঁচাতে নৌকা ঢোকানো হলো একটি ছোট খালের মধ্যে। মাঝি জানালেন, এটা নিশানখালি এলাকা। গত তিন ঘণ্টায় আমরা কোনো সংকেত পাইনি। তবে, নদীর পাড়ে কিছু বেঞ্চি ও মাঁচা পাতা দেখা গেছে।
বিনা বৃষ্টিতে মেঘ উড়ে যেতেই আবার যাত্রা শুরু। পথে দু’টি ডিঙ্গি নৌকার দেখা মিলল। চারদিনের অভিজ্ঞতায় ডাকাতদের কথা না জানতে চেয়ে জানতে চাইলাম ‘আমাদের লোকদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কিনা!’ তারা জানালেন, সামনে খালের গোড়াতেই আছে।
নৌকা চলল আরো দুই ঘণ্টা। কিন্তু কোনো সংকেত নেই। এক সময় মাঝি জানালেন, আমরা নির্দিষ্ট স্থান ছেড়ে চলে এসেছি শিপসা নদীর মোহনায়। সামনেই হিরণ পয়েন্ট। আমরা রাতের নিকষ অন্ধকারেই হতাশ হয়ে নৌকা আবার ঘোরালাম আঁদাচাইয়ের দিকে।
এবার ঘণ্টাখানেক নৌকা চালানোর পর রাত সাড়ে আটটার দিকে তিনটি টর্চলাইটের সংকেত দেখতে পেয়ে মনে শক্তি পেলাম। মিনিট দশেক পর একটি বড় বোটের সামনে এসে পৌঁছালাম। বোটের ছাদে কোলবালিশে হেলান দিয়ে আয়েশে বসে আছেন ছোট খাটো এক ব্যক্তি। নাম ইলিয়াস। সাতক্ষীরার স্থানীয় ভাষায় সাদর সম্ভাষণ জানালেন বছর বছর তিরিশেক বয়সের মানুষটি। তিনিই এখন রাজু বাহিনীর প্রধান।
বোটটি বিশাল জেলে নৌকা হলেও আধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো। সোলারের আলোয় ঝলমল করছে শিপসা নদীর বুক। জোয়ার শুরু হওয়ায় শান্ত অবস্থা অশান্ত শিপসার। বোটের ওপর ৩০ জন ডাকাত সদস্য সতর্ক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। প্রত্যেকের হাতে এইট শ্যুটার, নাইন শ্যুটার রাইফেল। কাঁধে ঝোলানো বড় সাইজের গুলির ব্যাগ। বেশিরভাগই কালো গেঞ্জি ও হাফ প্যান্ট পরা। বেশিরভাগেরই মাথায় চুল নেই।
আমাদের ছোট নৌকায় এতো ভয়ঙ্কর পথ আসতে দেথে দলনেতা মস্করা করলেন, ‘ভাইডি দেহি সাবমেরিন নিয়ে আইছে’!
অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের বোটটি ১১০ হর্স পাওয়ারের ফোর সিলিন্ডার বোটটির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো। নিমিষেই একটি বড় খালের মধ্যে ঢুকে পড়লাম আমরা।
এখানে একই সাইজের আর একটি বোট তিনটি জেলে নৌকা ও ৩৫ জন জিম্মি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। দলনেতা আমাদের জানালেন, এদের সঙ্গেই আমাদের তিন দিন থাকতে হবে। তিনি ২৫ জনের একটি বাছাই যোদ্ধা দল নিয়ে যাবেন অপারেশনে। ফিরবেন তিন দিন পর। এ তিনদিন রেখে যাওয়া দলের দলনেতা, মূল দলের ব্যবস্থাপকই দেখাশোনা করবেন আমাদের। সবার সঙ্গে কথা বলে দল সম্পর্কেও ধারণা নিতে পারবো আমরা।
এরই ফাঁকে দল সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা দিয়ে গেলেন তিনি। জানালেন, এ দলের বর্তমান স্টাফ ৪৩ জন। তারা সবাই অত্যাধুনিক অস্ত্রধারী। এর বাইরে আছেন মুহুরি, রাধুঁনি, ব্যবস্থাপক, বিভিন্ন ধরনের সহকারী ইত্যাদি। রাধুঁনি ও সহকারীদের জন্যও আছে অস্ত্র। তবে সেগুলো ম্যানুয়াল বিদেশি দো’নলা বন্দুক ও টু-টুবোর রাইফেল। কোনো দেশি অস্ত্র তারা ব্যবহার করেন না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের কাছ থেকে দখল করা দেশি অস্ত্র তারা নদীতে ফেলে দেন। এরই ফাঁকে কিছু অস্ত্র ও তার ব্যবহারবিধিও দেখালেন তিনি।
এরপর আর কথা না বাড়িয়েই দলনেতা অপারেশন টিম বাছাই শুরু করলেন। একে একে একেকটি সাংকেতিক নামে এক একজনকে নৌকায় ডাকছেন তিনি। এ এক এলাহী কাণ্ড! অটোমেটিক গান আর দেড় থেকে দুইশ’ রাউন্ডের গুলির ব্যাগ নিয়ে একেকজন গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন নেতার নৌকায়। কোনো কথার সুযোগ না দিয়েই দলনেতা চলে গেলেন তার তিন দিনের অজানা অপারেশনে।
আমরা নৌকায় ফিরে এসে সঙ্গীদের সঙ্গে অবস্থান নিলাম। রাতের খাওয়ার পর বোটের ছাদে পরিচয় পর্ব দস্যুদের সঙ্গে। এক একজন বলছিলেন, তাদের দস্যু হওয়ার গল্প। সত্যিই বিচিত্র তাদের গল্পগুলো। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ডাকাতদের গল্পগুলো থ্রিলে ভরপুর। অনেকের পরিবারের কেউই জানেন না- সন্তান কোন অনিশ্চয়তায় পা রেখেছে। কেবল জানেন, ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে ভালো বেতনে চাকরি করছেন তাদের স্বজন।
তাদের গল্পগুলো আসলেই দ্বিধায় ফেলছিল আমাদের।
এভাবেই চরম উত্তজনা আর উৎকণ্ঠায় কেটে গেল একটি অনিশ্চয়তার দিন। আগামী দিনের রহস্যের জন্য অপেক্ষা করেই ঘুমিয়ে পড়লাম খোলা নৌকার পাটাতনে। আর দস্যুরা তাদের বোটের কেবিনে ৬ জন করে কোলবালিশের আয়েশে। তাদের পাহারায় সার্বক্ষণিক পালাক্রমে ডিউটি অন্যদের। দুই ঘণ্টা করে পালাক্রমে পাহারা চলবে সারা রাত।
রহমান মাসুদ
সুন্দরবন থেকে ফিরে: দুই সপ্তাহের সুন্দরবন ভ্রমন। পুরোটাই নৌকা জীবন। মাঝে ২ রাত হোটেলে এসি ছেড়ে ঘুম। বাকি সময় নৌকার তক্তায় খোলা আকাশের নীচে। রোদ- পূর্ণিমার আলো ভরা জোয়ার, শুকনো ভাটা গহীন জঙ্গলের মধ্যে। ছোট্ট নৌকায় রান্না খাওয়া। এতো ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছি লিখতে কষ্ট হচ্ছিল।
ডাকাত খুজতে গিয়ে গুলির মুখোমুখি আবার তিনদিন ডাকাতের আতিথিয়েতা। জিম্মীদের আর লুন্ঠিতদের বোবাকান্নার দীর্ঘশ্বাস। দস্যুতার পেছনের গল্প।
পাখি পুলিশের যুদ্ধ যেমন দেখেছি, তেমনি মরা কুমির আর হরিণ শিকারের দৃশ্য ও দেখেছি। মাছ ধরতে গিয়ে সাপ ধরা আর ঝাকি জালের নিচে কুমির, তারপর মৌমাছির কামড়, নৌকায় গাছ থেকে গুঁইসাপের লম্ফ। কোনটা রেখে কোনটা যে বলি! বলে রাখি সুন্দরবন মানে কিন্তু কেবল করমজল, কটকা, হিরণ পয়েন্ট না। কেবল বাংলাদেশেই সুন্দরবন ৬০১৭ বর্গ কিলো মিটার…