গোটা ত্রিরিশেক ছোট-বড় দস্যুবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের ভয়ে সন্ত্রস্ত বনজীবীরা। র্যাব পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারে পরে কোনো কোনো বাহিনীর প্রধান মারা পড়ে। ভেঙ্গে যায় সে বাহিনী কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। আবার গড়ে ওঠে নতুন বাহিনী। শুরু হয় নতুন নতুন নামে নতুন সন্ত্রাস!!
টান দুই সপ্তাহের অভিযানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ ঘুরে এসে এসব বিষয়ে রিপোর্ট তৈরী করেছেন আমাদের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ। আজ ৩য় পর্ব।
সুন্দরবনের বনজীবিদের অপহরণ ও জিম্মি করে প্রতি মাসে চলে কোটি কোটি টাকার বানিজ্য। তবে এ অপরাধের তীর দস্যুদের দিকে কলেও তাদের দাবী ব্যবসায়ীরাই (মহাজন) জঙ্গলের ‘আসল ডাকাত।
সুন্দরবনে গড়ে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫শ’ বনজীবী দস্যুদের হাতে জিম্মি হন এবং মুক্তিপণের মাধ্যমে ছাড়াও পান। কিন্তু এ খবর লোকালয়ে আসে কমই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহাজন এবং পরিবারের লোক ছাড়া কেউই বিষয়টি বুঝতে পারেন না।
সুন্দবরনে প্রায় দেড়শ’টি কাঁকড়ার নৌকা আছে সাতক্ষীরার জেলার শ্যামনগরের এক কাঁকড়া ব্যবসায়ীর। নৌকাপ্রতি জঙ্গলে ওই ব্যবসায়ী প্রতি সিজনে (মৌসুমে) দস্যু ‘রাজু বাহিনী’র নামে ৬ হাজার টাকা জেলেদের কাছ থেকে আদায় করেন। কিন্তু রাজু বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড জাহাঙ্গীরের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি রাজু বাহিনীকে কোনো টাকাই দেন না। তার ভাষ্যমতে, এসব ব্যবসায়ীরাই জঙ্গলের ‘আসল ডাকাত’। তাদের হাতেই আসলে বন্দি বনের জেলেরা।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার নোযাবেকি ইউনিয়নের হাউয়াল ভাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান (৩২) পোনা ধরতে এসেছিলেন সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের শিপসা নদীর মোহনা এলাকায়। সেখান থেকে তাকে জিম্মি করেছে রাজু বাহিনী। জনৈক আয়ুব মাস্টার হাফিজুরের মহাজন। বন্দি অবস্থায় হাফিজুরকে দিয়ে বাবুর্চির সহকারীর কাজ করানো হচ্ছে।
হাফিজুর জানান, বাড়িতে তার ২টি সন্তান রয়েছে। সঙ্গে বাবা-মা ও স্ত্রী। সাধারণত তিনি মৌসুমী ফলের ব্যবসা করেন। কিন্তু এবার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে মহজানের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পোনা ধরতে এসেছিলেন। আর জঙ্গলে নামবেন না তিনি। প্রয়োজনে ভারতে গিয়ে হকারের কাজ করবেন।
হাফিজুর এই প্রতিবেদককে বলেন, ডাকাতদের সঙ্গে তার মহাজনের কথা হয়েছে। অনেক দেন-দরবারের পর ৩০ হাজার টাকায় তাকে মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে রাজু বাহিনী। মহাজনের কাছে তার পরিবার ২/১ দিনের মধ্যে টাকা দিলেই মুক্তি মিলবে তার।
হাফিজুরের মহাজন আয়ুব মাস্টার বলেন, আমরা বনে কাজ করি। এদের ঘাটিয়ে তো আমরা টিকতে পারবো না। আমাদের বনে না গিয়েতো উপায় নেই। মামলা করার পর বন থেকে তো আমাদের লাশটাও ডাঙ্গায় আসবে না।
তবে মহাজনরাও যে ‘ধোয়া তুলসি পাতা’- এটা ভাবার কারণ নেই বলে দাবি করলেন রাজু বাহিনীর একজন শীর্ষ নেতা।
তিনি বলেন, সুন্দরবনে কাজ করা জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়ালরা কেউই নিজেরা কাজ করেন না। তারা সবাই কোনো না কোনো ব্যবসায়ী ও মহাজনের হয়ে কাজ করেন। মহাজন-ব্যবসায়ীরা বন বিভাগ ও ডাকাতদের সঙ্গে সমঝোতা করে বনে মাছ ধরেন। এক্ষেত্রে বেশির ভাগই আমাদের কাছ থেকে টোকেন নিয়ে মাছ ধরেন। কেউ কেউ আমাদের টাকা না দিয়েই বনে লোক পাঠান। কিন্তু তিনি ঠিকই আমাদের কথা বলে জেলে-মৌয়ালদের কাছ থেকে টাকা কেটে নেন। আমরা ওই নৌকাগুলোকেই আটক করি।
এই ডাকাত সদস্য আরো জানান, জেলে-মৌয়ালরা মহাজনের কাছে ২/৩ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ থাকেন। যখন চুক্তির সময় শেষ হয়ে আসে এবং ওই জেলে বা মহাজন বেশি লাভে অন্য মহাজনের কাছে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে, তখন পুরোনো মহাজন আমাদের দিয়ে অপহরণ করিয়ে মুক্তিপণ দেন।
এতে মহাজনের ২টি লাভ হয়। একদিকে তিনি তার কর্মীকে টাকার বিনিময়ে মুক্ত করে আবার চুক্তিতে আবদ্ধ করলেন, অন্যদিকে আমাদের ৫০ হাজার টাকা দিয়ে হয়তো কর্মীদের ২/৩ গুণ বলে নগদ লাভবান হলেন বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, মহাজনরা এমনিতেই চতুর প্রকৃতির হন। তারা আমাদের ২০ হাজার টাকা দিলে বন্দির পরিবারের কাছে ৭০ হাজার টাকার গল্প করেন।
এসআই হক-নিউজ এডিটর/বিআই
রহমান মাসুদ
সুন্দরবন থেকে ফিরে: দুই সপ্তাহের সুন্দরবন ভ্রমন। পুরোটাই নৌকা জীবন। এতো ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছি লিখতে কষ্ট হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম কি লিখব! হয়ত অভিজ্ঞতার কিছুই উঠে আসেনি। তবু চেষ্টা করেছি।
এই অভিযানে দেখা পেয়েছি কিছু জীবন্ত ফসিলের। দেখেছি কুমির আর হরিণ শিকারের দৃশ্য। মাছ ধরতে গিয়ে সাপ ধরা, আর ঝাকি জালের নিচে কুমির, তারপর মৌমাছির কামড়, নৌকায় গাছ থেকে গুঁইসাপের লম্ফ। কোনটা রেখে কোনটা যে বলি!