বাগেরহাট জেলার শরণখোলা রেঞ্জ থেকে শুরু করে সাতক্ষীরা সীমান্তের তালপট্টি পর্যন্ত সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ বন এখন ছোট-বড় ৩০টি দস্যু বাহিনীর দখলে।
বনজীবীদের জিম্মি করে দস্যুরা কখনো তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে, কখনো বা কথায় কথায় চালাচ্ছে ছুরি, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিমেষে করে দিচ্ছে দুখান। আর সময় পাল্টেছে, সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে অস্ত্রের ধরন। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রও চলে গেছে দস্যুদের হাতে। ফলে বিশাল এই বনাঞ্চলের পাখিদের কলকাকলি, পশুদের নির্বিঘ্ন জীবন ব্যাহত করে ফাটে গুলি, মরে মানুষ।
কেবল যে দস্যুতা তাই নয়, দস্যুদের নিজেদের মধ্যে চলে আধিপত্যের লড়াই, চলে বন দখলের যুদ্ধ। তাতেও মারা পড়ে যখন তখন।
অনুসন্ধান বলছে, এই দস্যুবাহিনীর দিকে অনেকটা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রেখেছে বন বিভাগ, কোস্টগার্ড, র্যাব ও পুলিশ বাহিনীও। তাদের সহায়তায় ক্রমশঃই দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে বাহিনীগুলো। আর এদের সঙ্গে রয়েছে ডাঙ্গায় থাকা তাদের দালাল আর গড ফাদারদের পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে বাড়ছে অত্যাধুনিক অস্ত্রের সাপ্লাই, গড়ে উঠছে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের বিশাল মজুদ।
বিশাল এ বনাঞ্চলকে ঘিরে জীবিকা ৭ লাখ পরিবারের প্রায় অর্ধকোটি মানুষের। বনেই তাদের একমাত্র জীবিকা। আর এই বনজীবীরাই দস্যুদের মূল টার্গেট। অস্ত্রের মুখে বনজীবীদের জিম্মি করে মুক্তিপণ নিচ্ছে বনদস্যুরা। আর এই পথে প্রতিমাসে আদায় করছে কোটি কোটি টাকা।
সুন্দরবনের দস্যুতা নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বনজীবীরা যেসব মহাজন বা ব্যবসায়ীর হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে সেই ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই যোগসাজশ করে চলে সুন্দরববনে জিম্মি নাটক।
বিশাল বনাঞ্চল ঘুরে, সেখানকার ছোট ছোট বসতিগুলোতে (জেলে পল্লী) সময় কাটিয়ে, সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো বনদস্যুদের নানা কাহিনী।
এক সময় সূন্দরবনকে তিন ভাগে ভাগ করে শাসন করতো ৩টি বাহিনী। এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রস ফায়ারে লণ্ডভণ্ড প্রধান দু’টি বাহিনী। এদের দলনেতারাও র্যাব-পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে ক্রস ফায়ারে নিহত। কেবল ভারতে পালিয়ে প্রাণে বেঁচে আছেন রাজু বাহিনীর প্রধান রাজু।
বর্তমানে এই বাহিনীটি পরিচালনা করছেন রাজুর শিষ্য ইলিয়াস, জাহাঙ্গীর আর রফিক। দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন মারুফ আর মহুরীর দায়িত্ব সুমনের ঘাড়ে। ভারতে থেকেই বাহিনীর কাজ তদারকিতে আছেন রাজু নিজে।
তবে এরই মধ্যে জঙ্গলে এ-বাহিনী ‘জাহাঙ্গীর বাহিনী’ ও ‘ইলিয়াস বাহিনী’ নামেও পরিচিতি পেতে শুরু করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৫০ জন। ৪৩টি অটো রাইফেল এবং এইট শ্যুটার ও নাইন শ্যুটার গান আছে এদের হাতে। এর বাইরে আছে বেশ কিছু বিদেশি রাইফেল এবং দো-নলা বন্দুক। টু-টু বোর রাইফেল আছে ডজন খানেক। প্রায় সব মিলিয়ে ১২ হাজার রাউন্ড গুলি মজুদ তাদের।
সুন্দরবনের সবচেয়ে সংগঠিত এ বাহিনীর হাতে আছে ফোর সিলিন্ডার দুইটি হাইস্পিড স্পিডবোট। আরো একটি বোট বর্তমানে তৈরি হচ্ছে বলে জানালেন দলের গুরুত্বপূর্ণদের একজন।
রাজু বাহিনী তালপট্টি চর থেকে শুরু করে জঙ্গলের বাগেরহাট অঞ্চলের পুরোটাজুড়েই রাজত্ব করছে।
এর বাইরেও সুন্দরবনে রয়েছেকিছু খুচরা বাহিনী। সুন্দরবনের জেলে-বাওয়ালীদের কাছ থেকে জানা যায় গড়ে উঠা এসব বাহিনীর সম্পর্কে।
খলিল বাহিনী:
এ বাহিনীর দলনেতা খলিলের বাড়ি বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার ভাগা গ্রামে। ৫ সদস্যের এ বাহিনীটি কাছে আছে ১টি পাইপ গান, দু’টি এয়ারগান ও একটি কাটা রাইফেল। যা নিয়ে সুন্দরবনের ঝাপসি খাল, আন্ধারিয়ার খাল অঞ্চলে ডাকাতি ও জেলে-বাওয়ালীদের জিম্মি করাই তাদের কাজ।
ভাই ভাই বাহিনী:
দলের প্রধান মোশারেফ (মশা)’র বাড়ি রামপাল উপজেলার চাড়াখালী গ্রামে। ১০/১২ জনের দল নিয়ে মশা বনের চাঁদপাই রেঞ্জের ঝাপসি নদী, টগিরবগির খাল, ভদ্রা নদী, মানকির ভারানি ও শিপসা নদীর আঁদাচাই ফরেস্ট ফাঁড়ি পর্যন্ত দস্যুতা চালায়। এ দলের অস্ত্র আছে একটি সিক্স শ্যুটার বন্দুক, ৫টি একনলা বন্দুক, একটি পয়েন্ট টু-টু বোর রাইফেল।
আলিফ বাহিনী:
সাতক্ষীরার চালতেবাড়িয়া ও হরিনগর এর নীচে বাহির সমুদ্র্র এলাকায় দস্যুতা ও জেলে জিম্মির কাজ করছে এ বাহিনী। ভারতের সীমান্ত এলাকার সুন্দরবন এলাকায়ও এ বাহিনীর অবাধ বিচরণ রয়েছে। এই বাহিনীটি অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিধর। এদের হাতে আছে ১৭টি আগ্নেয়াস্ত্র ২২ জন সদস্য।
জোনাব আলী বাহিনী:
একসময় জেলে ছিলেন জোনাব আলী। কিন্তু দস্যুদের অত্যাচারে নিজেই অস্ত্র ধরে এখন মাছ ধরার পাশাপাশি ডাকাত দল করেছেন। নিজের জেলে-নৌকা রক্ষা করতেই এ বাহিনীর জন্ম। ৪/৫ টা বন্দুক নিয়ে জঙ্গলে রাতের অন্ধকারে ডাকাতি করে জনাব আলি। আবার দিনের বেলায় পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী।
বকর/বাবু বাহিনী:
পশ্চিম সুন্দরবন বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জের কয়রা থানার নীচের জঙ্গলেই এ বাহিনী ডাকাতি করে। এদের আছে ৪/৫টা বন্দুক।
রাঙ্গা বাহিনী (শুক্কুর):
৪/৫ টা পাইপ গান নিয়ে ডাকাতি করে রাঙ্গা বাহিনী। পূর্ব বাদা, নন্দবালা থেকে কাছাকাছি এলাকায় এরা ডাকাতি করে বলে জানা গেছে।
আলীম/মজিদ বাহিনী:
বর্তমানে সাতক্ষীরা অঞ্চলের সুন্দরবনে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম এই আলীম বাহিনী। কেবল জঙ্গলই নয়, বন সংলগ্ন এলাকা থেকেও তারা জিম্মি আটক কের মুক্তিপণ আদায় করছে। ভিতরকার সূ্ত্র জানায়, এদের কাছে ২৬টি আগ্নেয়াস্ত্র আছে। এদলের সদস্য সংখ্যা ও ২৬ জন। শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জসহ আশেপাশের এলাকায় এরা ডাকাতি করে। বনের কলাগাছিয়া এলাকা সম্পূর্ণই এদের দখলে।
জুম্মন (শুক্কুর):
৩টি পাইপ গান নিয়ে বন ও বন সংলগ্ন জয়মনি, করমজল, জোংড়া এলাকা ও লোকালয়ের কাছে দস্যুতা করে এ বাহিনী।
কালু বাহিনী:
খুলনার ফুলতলার কালু এই বাহিনীর প্রধান। ৭জনের দলটিতে বর্তমানে ২টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ২টি এক নালা বন্দুক, ৪টি পাইপ গান আছে। সুন্দরবনের আন্ধারমানিক নদী এলাকায় এ বাহিনী ডাকাতি করে।
মুসা বাহিনী:
বিভিন্ন বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যদের নিয়ে নতুন এ বাহিনী গড়ে উঠেছে। ৪টা পাইপ গান ও ৫ সদস্যের এ বাহিনীর আস্তানা কয়রা ও দাকোপের লোকালয় সংলগ্ন সুন্দরবন। বর্তমানে দলটি জেলে জিম্মি করে অস্ত্র জোগাড় করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
খোকা-বাবু বাহিনী:
শ্যামনগরের গাবুরার চাঁদমেনকা এই বাহিনীর প্রধান। ১০/১১ জনের বাহিনীর অস্ত্র সংখ্যাও ১১টা। এরা ডাকাতি করে সুন্দরবনের খোলশেবুনিয়া, মুরেলের খাল এলাকায়।
রাঙ্গা বাহিনী (২):
এই রাঙ্গা গাবুরার চাদমেনকা ও খোকা বাবুর ভাই)। এ দলের দস্যু সংখ্যা ৮ জন। প্রত্যেকের জন্য একটি করে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র আছে এই দলে। বাহিনীটি শিপসা নদীর পশ্চিম পাড়ের পাটকোস্টা ও আন্ধারমানিক এলাকায় ডাকাতি করে।
আমিনুর বাহিনী:
এ দলের দলনেতা গাবুরার চাদমেনকা-খোকাবাবুর বাহিনীর সাবেক সদস্য। ৭ টি অস্ত্র নিয়ে এ দলের সাত সদস্য সুন্দরবনের কালির খাল, কাটেশ্বর এলাকায় দস্যুতা চালাচ্ছে।
শীর্ষ বাহিনী:
সুন্দরবনের এক সময়ের ত্রাস শীর্ষ বাহিনীর প্রধান রেজাউল ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর দলটি চার ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এদের মধ্যে মোড়েলগঞ্জ এলাকার বেল্লাল ২০ জন সদস্য ও ১৪টি অস্ত্র নিয়ে বেল্লাল বাহিনী নামে নারকেলবাড়িয়া ও ছাপড়াখালি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। ৮ সদস্য ও ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আউয়াল বাহিনী জয়মনি ও হাড়বাড়িয়া এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছে। রামপালের মোশারেফ হাড়বাড়িয়া ও ঝাপসি এলাকায় ৭/৮টি অস্ত্র ও ১০ সদস্য নিয়ে দস্যুতা চালাচ্ছে। এই বাহিনীর আর এক সদস্য ফরিদ লাহিড়ি চলতি মাসে তিন সঙ্গী, তিনটি অস্ত্র ও ৯৯৪ রাউন্ড গুলিসহ র্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
কামাল বাহিনী:
৪/৫টা অস্ত্র ও ৪/৫ জন সদস্য নিয়ে এ বাহিনী বাগেরহাটের শরণখোলা অঞ্চলের বন সংলগ্ন লোকালয়ের কাছে থেকেই দস্যুতা চালাচ্ছে বলেই জানালেন বনজীবীরা।
সোহরাব বাহিনী:
মোড়েলগঞ্জ, আমুরবুনিয়া, জিউধারা এলাকায় ডাকাতি এই বাহিনী। তবে আগ্নেয়াস্ত্র ২টি। ও ৪/৫ জন সদস্য রয়েছে এই বাহিনীতে। বাকিরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে ডাকাতির অভিযানে নামে।
মালেক বাহিনী:
শরণখোলার কাকড়ামারির খালে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য এই বাহিনী গঠন করে দলনেতা মালেক। সদস্য সংখ্যা ৫জন ও অস্ত্র ২টি।
শান্ত বাহিনী:
শরণখোলার বিভিন্ন স্থানে শান্ত বাহিনী নামে দস্যুতা করছেন নমির ও সমির নামের দুই ভাই। এ বাহিনীর কাছে ৫টি বন্দুক ও ৬ জন সদস্য রয়েছে। হাড়বাড়িয়া ও চরাপুটিয়া এলাকায় এ বাহিনী ডাকাতি করে।
তৌহিদুল দফাদার (বৈদ্যমারি):
এ বাহিনীটি একটি বিলাসী ডাকাত দল, বলেন একজন বনজীবী। বৈদ্যমারির তৌহিদুল দফাদার এ দলের প্রধান। ১১/১২ টা অস্ত্র নিয়ে এরা মাঝে মাঝে জঙ্গলে নামে। মনচাইলে ডাকাতি করে মন না চাইলে করে না।
নিরব বাহিনী:
এটি একটি ভারতীয় ডাকাত দল। বনজীবীরা জানান ভারত থেকে প্রায়ই বাংলাদেশে প্রবেশ করে নিরব বাহিনী। তবে এর বেশি কিছু তারা জানাতে পারেন নি।
রহমান মাসুদ
সুন্দরবন থেকে ফিরে: দুই সপ্তাহের সুন্দরবন ভ্রমন। পুরোটাই নৌকা জীবন। মাঝে ২ রাত হোটেলে এসি ছেড়ে ঘুম। বাকি সময় নৌকার তক্তায় খোলা আকাশের নীচে। রোদ- পূর্ণিমার আলো ভরা জোয়ার, শুকনো ভাটা গহীন জঙ্গলের মধ্যে। ছোট্ট নৌকায় রান্না খাওয়া। রাজহাঁস, মুরগী, চিংড়ি, ভোলা মাছ, কোরাল, কাকঁড়া দিয়ে দিনে দুইবার খাওয়া। খালের লোনা জলে গোসল। সকালে লাল চা আর মুড়ি। একাধিকবার তরমুজ। ডাকাত খুজতে গিয়ে গুলির মুখোমুখি আবার তিনদিন ডাকাতের আতিথিয়েতা। জিম্মীদের আর লুন্ঠিতদের বোবাকান্নার দীর্ঘশ্বাস।
দস্যুদের গল্প, দস্যুতার পেছনের গল্প। ডাঙ্গায় ফিরে যাওয়া ডাকাতদের বেচেঁ থাকার লড়াই। হয়ত অভিজ্ঞতার কিছুই উঠে আসেনি। তবু চেষ্টা করেছি।