বাগেরহাটের রামপাল থানা গেট পেরুলেই সামনে খেয়াঘাট। ইজারাদারের এক দল লোক বসে জটলা করছেন চালার নিচে। জনপ্রতি ঘাটের মাসুল আড়াই টাকা। জটলা পেরুলে কাঠের পাটাতন চলে গেছে দূর বরাবর। কিন্তু পেরুবো কী! নদী কোথায়!
কাঠের পাটাতনের এ মাথা থেকে ও মাথার পাটাতন পর্যন্ত থকথকে কাদা। সেই কাদার ওপর সারি সারি নৌকা লম্বালম্বিভাবে বাঁধা। এভাবেই নদীর বুকে ঘাটের মাঝিরা তৈরি করেছেন অস্থায়ী নৌকা ব্রিজ।
এই নৌকা ব্রিজ পার হতে দিতে হয় জনপ্রতি ৩ টাকা।
এই ঘাটই সম্বল আব্দুল হকের রুটিরুজির। ৬০ পেরুনো এই নৌ-শ্রমিক জানান, চোখের সামনে অল্প সময়ে মারা যাওয়া খরস্রোতা রামপাল নদীর মৃত্যু কাহিনী।
তিনি বলেন, ১০ বছর হবে মরা শুরু হয়েছিল কচা নদী থেকে উৎপত্তি রামপালের। কিন্তু বছর পাচেঁক হলো অবস্থা বেগতিক। আগে ভাটায় অপেক্ষা করে জোয়ারে চলাচল করত চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছেড়ে আসা মংলা ও খুলনা নৌ-বন্দরের জাহাজগুলো। কিন্তু এখন জোয়ারে একটি মাঝারি আকারের নৌকাও চলাচল করতে পারেনা। আর ভাটায় নদী থাকে সম্পূর্ণ পানিশুন্য।
ঘাট শ্রমিকরা বলেন, এই নদী দিয়ে কিছুদিন আগেও ঢাকা খুলনার মধ্যে চলাচলকারী গাজী, অস্ট্রিচ, মাসুদ, লেপচা নামের স্টিমার চলাচল করত। খুলনা, বরিশাল থেকে কারবারিরা মালামাল কম খরচে এখানে নিয়ে আসতেন। সেই ঘাটে শ্রমিকের কাজ করেই তাদের সংসার চলত। এখন নদী মরে যাওয়ায় স্টিমার লাইন বন্ধ হয়েছে। তারাও পেশা হারিয়ে সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
ঘাট শ্রমিক শাজাহান জানান, এই ঘাট দিয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ পারাপার হন। মালামাল নিয়ে এক নৌকা থেকে আর এক নৌকা হয়ে চলাচল করতে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই।
রামপাল বাজারের ব্যবসায়ী আবু সালেহ বাগেরহাট ইনফোকে জানান, নদী মরে যাওয়ার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ছে মানুষের পকেটে। আগে বরিশাল বা খুলনা থেকে নৌ-পথে যে পণ্য আনতে পাঁচশো টাকা খরচ হতো ব্যবসায়ীদের, সড়ক পথে সে পণ্য আনতে বর্তমানে খরচ পড়ছে কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা। তাই বাধ্য হয়েই কাস্টমারের পকেট থেকে বাড়তি খরচ তুলে নিতে হয় তাদের।
নদীর এ অবস্থা কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ঘাট শ্রমিকরা সবাই একজোরে চিৎকার করে ওঠেন। সামছু মাঝি, বেলায়েত, আক্কাছ, সফিউলসহ সবাই একস্বরে বলে ওঠেন- ‘বছর দুইর জন্যি ঘের-দড়ি ছাইড়ে দেন দ্যাহি গাঙ্গ আবার জাইগে ওটপে।’
তারা বলেন, এই নদীর উজানে কচা নদীতে এখনও পানি আসে। কিন্তু নদীর মাঝ খান শুকিয়ে উঁচু হয়ে গেছে।
তাদের মতে এর কারণ জানান, পশুর নদী থেকে রামপাল নদীতে জোয়ারে ঠিকই এখনো কিছু পানি আসে। কিন্তু যে পানি আসে, তা ঘের মালিকরা খালের মাধ্যমে টেনে পুরোটাই ঘেরে ঢুকিয়ে নেন। ভাটায় আর কোনো পানি পশুরে ফিরে যায়না। ফলে নদীতে স্রোত বলতে কিছু নেই। স্রোতহীন নদী তো মরবেই।
তারা বলেন, এখনই সব ঘের ছেড়ে দেন, দেখবেন স্রোত তৈরি হয়ে কাদা সাগরে চলে যাবে। নদী ফিরে পাবে তার আগের রূপ।
এই ঘাটেই মালামাল, মটরবাইক পার করা হয় ডিঙ্গি নৌকায় করে টেনে টেনে।
নদীর বুকেই দখলের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে সারি সারি মাছের ঘের। অবাক বিষয় হলো নদী শুকনো হলেও মাইলের পর মাইল ঘেরে পানির কমতি নেই। জোয়ারের পানি আটকিয়ে, অবৈধ বাঁধ, স্লুইস গেট বসিয়ে নদীকে করা হয়েছে শূন্য।
এই অবস্থায় এখানকার পুকুরের পানিও হয়ে উঠেছে লবণাক্ত। লবণে অক্রান্ত হয়ে মরছে সব গাছ। কেবল গুটিকয়েক নারকেল, তাল, খেজুর ছাড়া পুরো এলাকাই প্রায় গাছ শূন্য।
দেখলেই বোঝা যায় রামপাল নদীর সঙ্গে সঙ্গে মরতে চলেছে একটি আস্ত জনপদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য।
সূত্রঃ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
রামপাল, বাগেরহাট থেকে ফিরে: নদীর নাম রামপাল। ৪/৫ বছর আগেও এ নদী দিয়ে গাজী, অস্ট্রিচ,মাসুদ নামের প্যাডেল স্টিমার চলত। এখন সেই নদী ঘের মালিকদের কারণে মরে গেছে বলে অভিযোগ নৌ-শ্রমিকদের।