অপহরণ আতঙ্ক দেশ জুড়ে নতুন হলেও, নতুন নয় সাগর ও বনে। বনদস্যু আর জলদস্যুদের কারণে প্রতিনিয়ত এই আতঙ্ক নিয়েই সুন্দরবন এবং বঙ্গোপসাগরে যেতে হয় উপকুলের কয়েক লক্ষ জেলেদের।
বঙ্গোসাগরের পরেই উপকূলীয় জেলেদের মৎস আহরণের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র সুন্দরবন। পুরো বছর জুড়েই জেলেরা সুন্দরবনে মাছ আহরণ করলেও ইলিশ এবং শুটকি মৌসুমে বনে জেলেরা আসে সবচেয়ে বেশি।
আর এ দুই সময়ে সাগর ও সুন্দরবনে বেড়ে যায় দস্যুতা আর মুক্তিপনের দাবিতে অপহরণের ঘটনা।
সুন্দরবনে বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধারাবাহিক অভিযানে দস্যু বাহিনীগুলো কোনঠাশা হয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হলেও চলতি ইলিশ মৌসুমের শুরুতেই দস্যুদের তান্ডবে অসহায় হয়ে পড়ছেন জেলেরা।
শুধু মাত্র পূর্ব সুন্দরবন এবং সংলগ্ন উপকুল থেকে গত এক সপ্তাহে শতাধিক জেলেকে অপহরণে করেছে দস্যুরা। এদের মধ্যে অনেকে অবশ্য মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছে।
বৃহস্পতি ও শুক্রবার সাগর থেকে ফিরে আসা বাগেরহাট, শরণখোলা ও মংলার মৎস্য আড়তের জেলেরা বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
সাগর থেকে ফিরে আসা একাধিক জেলে জানান, জলদস্যুদের বেপরোয়া তাণ্ডবে জেলেরা উপকূলসহ গভীর সমুদ্রে ইলিশ আহরণ করতে পারছেন না। দস্যু বাহিনীগুলোকে যে সব ট্রলার চাঁদা দিচ্ছে না, সে সব ট্রলার ইলিশ আহরণ করতে নানা বিড়ম্বনায় পড়েছে। এসব ট্রলার দস্যুরা অপহরণ করে জেলেদের মুক্তিপণের দাবিতে সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে আটকে রাখছে।
গত দুই বছরে র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সুন্দরবনেসহ উপকূলীয় এলাকায় অন্তত ৪১ দস্যু নিহত হয়। তার পরও থেকে নেই দস্যুতা। বন্দুকযুদ্ধে বাহিনী প্রধান বা সেকেন্ড ইনকমান্ড নিহত হলেও অন্য সদস্যরা নতুন নতুন বাহিনী গঠন করে জেলেদের ওপর তন্ডব চালায়।
সবশেষ মঙ্গলবার রাতে পূর্ব সুন্দরবনের শরনখোলা রেঞ্জের ধানসাগর ফরেস্ট ষ্টেশনের তাম্বুলবুনিয়া এলাকা থেকে মুক্তিপণের দাবিতে ৮ জেলেকে অপহরণ করেছে বনদস্যু ছোট ওরফে আওয়াল ও হারুন বাহিনীর সদস্যরা।
অপহৃতরা হলো-বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের খালেক হাওলাদারের ছেলে রবিউল ইসলাম, রহমান হাওলাদারের ছেলে জাকারিয়া, শাহ আলম চৌকিদারের ছেলে রাসেল, মালেক বয়াতীর ছেলে আ. খালেক। অপর অপর তিন জেলের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
৮ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে যৌথভাবে দস্যুরা এ অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জেলেরা জানান।
বাগেরহাটের শরনখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের কয়েকজন জেলে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, মঙ্গলবার রাত ৯ টার দিকে উত্তর রাজাপুর এলাকার জেলেরা সুন্দরবনের তাম্বুলবুনিয়া খালে মাছ ধরছিলেন। এমন সময় দুই গ্রুপের বনদস্যুরা যৌথভাবে জেলেদের নৌকায় হানা দিয়ে ৮ জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে দস্যুরা মুঠোফোনে অপহৃত ওই জেলেদের মহাজনদের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে এক লাখ টাকার করে মোট ৮ লাখ টাকা দাবী করে। বিষয়টি তারা বন বিভাগকে অবহিত করেছেন বলেও জানান ওই জেলেরা।
সুন্দরবনের ধানসাগর ফরেস্ট ষ্টেশনের কর্মকর্তা (এসও) মো. আব্দুল বারী বুধবার সন্ধায় বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, জেলে অপহরণের ঘটনাটি তারা শুনেছেন। বিষয়টি কোষ্টগার্ডকে জানান হয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার (২৩ মে) মংলা পশুর চ্যানেলের হারবাড়িয়া এলাকা থেকে মুক্তিপণের দাবিতে ৫০ জেলেকে অপহরণ করেছে সুন্দরবনের বনদুস্য আওয়াল বাহিনী ওরফে ছোট বাহিনী।
সে সময় মুক্তিপনের দাবিতে অপহৃত মংলা উপজেলার চাঁদপাই কালিকাবাড়ির জেলে সমির মন্ডল ফিরে এসে জানান, শুক্রবার সন্ধ্যায় সুন্দরবন সংলগ্ন হারবাড়িয়া এলাকায় শতাধিক জেলে মাছ শিকার করছিল। এ সময় আওয়াল বাহিনীর ১০/১২ জনের একটি সশস্ত্র দল জেলে বহরে হামলা চালিয়ে মাছ-জাল লুট করে এবং মুক্তিপণের দাবিতে ৫০ জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এসব জেলেরা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছে।
ট্রলার মালিক ও আড়তদারদের সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবন উপকূলে মুর্তজা বাহিনীসহ কয়েকটি জলদস্যু বাহিনী চলতি ইলিশ আহরণ মৌসুমের শুরুতেই ট্রলার ও নৌকাপ্রতি ৭০ থেকে ৯০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছে।
বাগেরহাটের মংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের জয়মনি এলাকার জেলে চান মিয়া, লাল মিয়া, ফারুখসহ আরো কয়েক জন বাগেরহাট ইনফোকে জানান, দস্যুদের দাবিকৃত চাঁদা দিতে ব্যর্থ হলে ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলোতে বনদস্যুরা হানা দিয়ে মাছসহ ট্রলার-নৌকা লুটে নিচ্ছে এবং অস্ত্রের মুখে জেলেদের জিম্মি করে সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে আটকে রাখছে।
এর পর অপহৃত এসব জেলেদের পরিবার ও ট্রলার মালিকদের কাছে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ।
তবে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এসব অপহরণের ঘটনা জানিয়ে দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ট্রলার মালিকরা কোনো প্রতিকার পাননি।
কখনও ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার মালিকরা মুক্তিপণের টাকা দিতে দেরি করলে বা অস্বীকৃতি জানালে জেলেদের হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছেন জেলেরা। এসব কারণে সুন্দরবন উপকূলসহ গভীর সমুদ্রে ইলিশ আহরণে নিয়োজিত ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো বাধ্য হয়ে বনদস্যু ও জলদস্যু বাহিনীগুলোকে চাঁদা দিয়ে সমুদ্রে ইলিশ আহরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
এ ব্যাপারে মংলাস্থ কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার আলাউদ্দিন বাগেরহাট ইনফোকে জানান, তারা সুন্দরবনে দস্যু দমনে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সবশেষ আমরা মঙ্গলবার বিকেলে সুন্দরবনের কৈখালী এলাকায় বনদস্যুরা মুক্তিপণের দাবিতে জেলেদের জিম্মি করে রেখেছে -এমন সংবাদের ভিত্তিতে ওই এলাকায় অভিযান চালায় তারা।
তিনি বলেন, এ সময় কোস্টগার্ড সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে দস্যুরা গহীন বনে পালিয়ে যায়। পরে তাদের আস্তানা থেকে অপহৃত ১১ জেলে, ৩৬টি আগ্নেয়াস্ত এবং ১৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
সাম্প্রতি সময়ে অবারও উপকূলে দস্যুতা বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে পূর্ব সুন্দরবনে দস্যুতা দমনে কাজ করা র্যাব-৮ এর অপারেশন অফিসার গুলজার আহমেদ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বর্তমানে সুন্দরবন এলকায় তাদের কোন দল অভিযানে না থাকলেও দস্যুতা দমনে র্যাবের গোয়েন্তা তৎপরাত অব্যহত রয়েছে।