মৌসুমের শুরুতে একদিকে সাগরে ইলিশ না পাওয়ার বেদনা। অন্যদিকে অন্যদিকে জলদস্যুদের তান্ডবে অসহায় হয়ে পড়ছেন জেলেরা। গত ১৫ দিনে শতাধিক জেলে অপহৃত হয়েছে। তাদের মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে কেউ ফিরে এসেছে। আর অনেকেই মুক্তিপণ দিতে পারছে না, মুক্তিও মিলছে না।
বুধবার সাগর থেকে ফিরে আসা মংলার মৎস্য আড়তের জেলেরা বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।
জেলেরা জানান, দস্যু বাহিনীগুলোকে যে সব ট্রলার চাঁদা দিচ্ছে না, সে সব ট্রলার ইলিশ আহরণ করতে নানা বিড়ম্বনায় পড়ছে। দস্যুরা ওই সব ট্রলারে হামলা করছে, জেলেদের ধরে নিয়ে সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে আটকে রাখছে। এর পর মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে।
তাদের অভিযোগ, উপকূলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বক্ষণিক তদারকির অভাব। আর এতে দেড় লাখ জেলে বছরের পর বছর দস্যু বাহিনীগুলোর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।
গত দেড় দুই বছরে র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অন্তত ৪১ দস্যু নিহত হয়েছে। এর পরও নতুন নতুন জলদস্যু বাহিনী গঠিত হচ্ছে। চলছে জেলেদের ওপর তান্ডব।
গত শুক্রবার মংলা পশুর চ্যানেলের হারবাড়িয়া এলাকা থেকে মুক্তিপণের দাবিতে ৫০ জেলেকে অপহরণ করেছে সুন্দরবনের বনদুস্য আওয়াল বাহিনী ওরফে ছোট বাহিনী।
মংলার চাঁদপাই ইউনিয়নের কালিকাবাড়ির জেলে সমির মন্ডল জানান, শুক্রবার সন্ধ্যায় সুন্দরবন সংলগ্ন হারবাড়িয়া এলাকায় শতাধিক জেলে মাছ শিকার করছিল। এ সময় আওয়াল বাহিনীর ১০/১২ জনের একটি সশস্ত্র দল জেলে বহরে হামলা চালিয়ে মাছ-জাল লুট করে এবং মুক্তিপণের দাবিতে ৫০ জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অবশ্য এসব জেলেরা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছে বলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
সর্বশেষ মঙ্গলবার পূর্ব সুন্দরবনের ধানসাগর ফরেস্ট স্টেশনের তাম্বুলবুনিয়া এলাকা থেকে ৮ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে ৮ জেলেকে অপহরণ করেছে বনদস্যু ছোট ওরফে আওয়াল ও হারুন বাহিনী।
অপহৃত জেলেদের মধ্যে পাঁচজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার উত্তর রাজাপুর গ্রামের খালেক হাওলাদারের ছেলে রবিউল ইসলাম, রহমান হাওলাদারের ছেলে জাকারিয়া, শাহ আলম চৌকিদারের ছেলে রাসেল, মালেক বয়াতীর ছেলে আ. খালেক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উত্তর রাজাপুর গ্রামের কয়েকজন মৎস্য ব্যবসায়ী জেলেদের বরাত দিয়ে জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উত্তর রাজাপুর এলাকার জেলেরা বনের তাম্বুলবুনিয়া খালে মাছ ধরছিলেন। এমন সময় দুই গ্রুপ বনদস্যু যৌথভাবে জেলেদের নৌকায় হানা দিয়ে ৮ জেলেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে দস্যুরা মুঠোফোনে অপহৃত ওই জেলেদের মহাজনদের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে ৮ লাখ টাকা দাবি করে। বিষয়টি তারা বন বিভাগকে অবহিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ধানসাগর ফরেস্ট ষ্টেশনের কর্মকর্তা (এসও) মো. আব্দুল বারী বুধবার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, জেলে অপহরণের ঘটনাটি তারা শুনেছেন। এ ব্যাপারে তিনি বিস্তারিত খোঁজখবর নিচ্ছেন।
জেলে, ট্রলার মালিক ও আড়তদারদের সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবন উপকূলে মুর্তজা বাহিনীসহ কয়েকটি জলদস্যু বাহিনী চলতি ইলিশ আহরণ মওসুমের শুরুতেই ট্রলার ও নৌকাপ্রতি ৭০ থেকে ৯০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে।
মংলার চিলা জয়মনি এলাকার মাছধরা ট্রলারের মাঝি ফারুক, চান মিয়া, লাল মিয়া, নুর মিয়া জানান, দাবিকৃত চাঁদা দিতে ব্যর্থ ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলোতে বনদস্যুরা হানা দিয়ে মাছসহ ট্রলার-নৌকা লুট ও জেলেদের অপহরণ করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণের দাবিতে সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে আটকে রাখছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এসব অপহরণের ঘটনা জানিয়ে দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ট্রলার মালিকরা কোনো প্রতিকার পাননি।
কখনও ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার মালিকরা মুক্তিপণের টাকা দিতে দেরি হওয়ায় জেলেদের হত্যা করে বন ও সাগরে নিক্ষেপ করার ঘটনা ঘটেছে বলে জেলেরা জানিয়েছেন। সে কারণে সুন্দরবন উপকূলসহ গভীর সমুদ্রে ইলিশ আহরণে নিয়োজিত ট্রলার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলো বাধ্য হয়ে বন ও জলদস্যু বাহিনীগুলোকে চাঁদা দিয়ে টোকেন নিয়েই সমুদ্রে ইলিশ আহরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার আলাউদ্দিন জানান, তারা সুন্দরবনে দস্যু দমনে অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।সবশেষ তারা মঙ্গলবার বিকেলে সুন্দরবনের কৈখালী এলাকায় বনদস্যুরা মুক্তিপণের দাবিতে জেলেদের জিম্মি করে রেখেছে -এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওই এলাকায় অভিযান চালায় ।
এ সময় কোস্টগার্ড সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে দস্যুরা গহীন বনে পালিয়ে যায়। পরে তাদের আস্তানা থেকে ৩ টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১৬ রাউন্ড গুলিসহ অপহৃত ১১ জেলেকে উদ্ধার করা হয়।
সময় জেলেদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বন সংলগ্ন খাল থেকে তাদের (জেলেদের) পাঁচটি নৌকাও উদ্ধার করা হয় বলে জানান কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের ওই কর্মকর্তা।