একের পর এক আগুন লাগছে সুন্দরবনের বৃক্ষরাজিতে। বিগত ১০ বছরের অন্তত ১৬ দফা আগুন লেগেছে সুন্দরবনে।
আর এসব অগ্নিকাণ্ডে কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ নষ্ট হয়েছে বলে বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়।
সূত্রমতে, সুন্দরবনে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০০৪ সালে। ওই বছর চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলি ও আড়য়ার খাল এলাকায় বনের ভিতর দু’দফা আগুন লাগে। এর পর ২০০৫ সালের ৮ এপ্রিল একই রেঞ্জের আমর বুনিয়া এলাকায় অপর একটি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার বনাঞ্চল পুড়ে যায়। পরদিন ৯ এপ্রিল রেঞ্জের কলমতেজি টহল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভিতরে এবং ধানসাগর স্টেশনের মূর্তির খাল এলাকায়, ১৩ এপ্রিল তুলাতলা এলকায় আগুণ লাগে।
এর আগে ১৯ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের তেরাবেকা এলাকায় সৃষ্ট দাবালনলে পুঁড়ে যায় প্রায় দেড় একর বনভূমি। ২৫ মার্চ নাংলি এলাকার এবং ২৭ ডিসেম্বর ধানসাগর ষ্টেশন সংলগ্ন এলাকায় পৃথক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
২০০৬ সালের ৩০এপ্রিল পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের পচাকুড়ালিয়া এলাকায় প্রায় ২শ’ একর বনভূমি পুড়ে যায়। ভয়াবহ এ অগ্নিকান্ডে বিস্তার ঘটে বনের ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। এ ঘটনার কয়েক দিনের মাথায় তেরাবেকা, কলমতেজি, নাংলি এলাকায় আবার আগুণের সূত্রপাত হয়।
২০০৭ সালে নাংলি এলাকার পচাকুড়ালিয়া এবং ডুমুরিয়া ক্যাম্প এলাকায় এবং ২০০১ সালে একই সুষ্ক মৌসুমে ধানসাগর ষ্টেশনের পঁয়ষট্রি ছিলা এলাকায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এছাড়া ওই এলাকার বাহিরে ২০০২ সালে শরণখোলা রেঞ্জে কটকা অভায়ারণ্য এলাকায় অগ্নিকান্ডে প্রায় ২একর এলাকার বনজ সম্পদ পুড়ে যায়।
২০১১ সালে মার্চ মাসে তিন দফা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ১মার্চ নাংলি এলাকার ২৫ নম্বর কমপামেন্টে প্রথম দফার আগুনে দেড় একর এলাকার বনসম্পদ ভূস্মীভূত হয়। টানা ৩দিন পর এ আগুণ নিয়ন্ত্রণে এলেও ৮মার্চ আড়য়ার বেড় নদী থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটর ভিতরে আবার আগুণ লাগে। এ আগুণ নেভাতে না নেভাতেই ভোলা নদী থেকে প্রায় ২কিলোমিটার দূরে গহীন বনে হঠাৎ আগুন জ্বলে ওঠে। বনবিভাগ দমকল বাহিনী এবং এলাকাবাসীর সহায়তায় ৪দিনের মাথায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
৩দফা এ অগ্নিকাণ্ডে দশ একর এলাকার বনজ সম্পদ পুড়ে যায়। এতে ভস্মীভূত হয় কয়েক কোটি টাকার, সুন্দরী, বাইন, আমুর, গেওয়াওসহ অন্যান্য বৃক্ষরাজী ও লতাপাতা ।
সবশেষ বুধবার সন্ধ্যায় পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাদঁপাই রেঞ্জের গুলিশাখালী ও আমুরবুনিয়া ফরেষ্ট ক্যাম্পের মাঝামাঝি বাইশেরছিলা এলাকার আগুণ লেগেছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আগুণ সম্পূর্ণ রুপে নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) আমীর হোসাইন চৌধুরী বাগেরহাট ইনফোকে জানান, ওই এলাকায় এখনও মাটি চাপা আগুণ জ্বলছে। আগুণ নিয়ন্ত্রণ নিতে বন বিভাগের পাশাপাশি মোড়েলগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস কাজ করছে। এ ঘটনায় চাঁদপাই রেঞ্জের এসিএফ(ভারপ্রাপ্ত) আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পুরোপুরি আগুণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর তদন্ত কমিটি কাজ করবে। তখন আগুণের সঠিক ক্ষয়ক্ষতির পরমাণ ও কারণ জানা যাবে বলে জানান তিনি।
অবশ্য স্থানীয় অধিবাসীরা প্রাথমিকভাবে বন বিভাগের কাছে আগুন লাগার তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন৷
প্রথমত, মৎস্যজীবীদের রান্নার চুলা থেকে আগুন লাগতে পারে৷ দ্বিতীয়ত, মধু আহরণের জন্য মৌচাকে মৌয়ালদের দেওয়া ধোঁয়ার জন্য তৈরি আগুন সঠিকভাবে না নেভানোর ফলে তা ছড়িয়ে পড়ে থাকতে পারে এবং তৃতীয়ত, বন্য প্রাণী শিকার বা অন্য কোনো কারণে বনদস্যুদের জ্বালানো আগুন ছড়িয়ে এ অবস্থা হয়ে থাকতে পারে৷
ঘটনাস্থল থেকে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা ফায়ার স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা মো. আরিফুল হক মুঠোফোনে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, বনের ১৪/১৫ একর এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। যেখানে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে, সেখানেই পানি দেওয়া হচ্ছে। আগুন ছড়িয়ে পড়া ঠেকানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু মাটির নিচ থেকে আগুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের সংরক্ষিত নথি ও বিভিন্ন সময়ে বনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পূর্ব বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের বনভূমির উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশে কিছু নিচু এলাকায় প্রায় প্রতিবছর বসন্তের শেষে এবং গ্রীষ্ম মৌসুমের শুরুতে প্রবল বাতাস ও দাবদাহের সময় আগুন লাগে৷ এসব এলাকায় বর্ষায় পানি জমে, শীতকালে শুকিয়ে যায়। এসব এলাকায় সাধারণত গুল্ম, ঘাস, লতাপাতা ও ঝোপজাতীয় গাছ দেখা যায়৷ বড় গাছ জন্মে না।
সারা বছর গাছের পাতা ঝরে পানিতে পড়ে আধা পচা পাতার স্তর তৈরি হয়। শুকনো মৌসুমে পানি শুকিয়ে গেলে ঝরা পাতার এই স্তরের ভাঁজে মিথেন গ্যাস জমে। এ অবস্থায় প্রখর সূর্যতাপ বা বনজীবীদের ব্যবহৃত আগুন থেকে এসব এলাকায় আগুন লাগে। মিথেন গ্যাসের প্রভাবে আগুনের তীব্রতা ও ব্যাপ্তি বাড়ে।
বন বিভাগ বলছে, বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এ ধরনের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে না, পাতার নিচে মাটি ও শেকড়ের ভেতর দিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে ধিকিধিকি জ্বলে উত্তাপ ও ধোঁয়া সৃষ্টি করে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলের আশপাশে নদী-খাল অর্থাৎ পানির উৎস না থাকলে আগুন নেভানোর কাজ বাধাগ্রস্ত হয়।