আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি আর ঋণ কেলেঙ্কারির ধারাবাহিকতায় এবার যুক্ত হচ্ছে বাগেরহাটের কচুয়ায় অগ্রণী ব্যাংকের একটি শাখা।
লোনের বিপরিতে সকল ডকুমেন্ট না রাখা, কৃষি লোন বিতরনে অনিয়ম, ঋণ কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে শাখাটি থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে বলে জানা গেছে। আর এ অভিযোগ তদন্তে নোমছে ব্যাংকের জোনাল (আঞ্চলিক) অফিস।
লোনের বিপরিতে সকল ডকুমেন্ট না থাকা, একই ব্যক্তির নামে একাধিক কৃষি লোন, লেজার সুষম না থাকা, অনিয়ম, অসামঞ্জস্যতা প্রভৃতি অসঙ্গিতির জন্য বর্তমানে অডিট চলছে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড গোয়ালমাঠ শাখায়।
জানা গেছে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি শাখাটিতে নতুন ব্যাবস্থাপক যোগদানের পর দায়িত্ব বুঝে নিতে গিয়ে নানা অনিয়ম আর ঋণ অসমঞ্জস্যতা ধরা পড়তে থাকে। শুরু হয় তদন্ত (অডিট)। আর এই তদন্ত থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে একের পর এক গোজামিল ও জালিয়াতির তথ্য।
ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির এ ঘটনা জানার পর থেকেই বাগেরহাট ইনফো এব্যাপারে তথ্য প্রমান সংগ্রহ এবং অনুসন্ধান শুরু করে।
বাগেরহাট ইনফো ডটকামের বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের এই শাখা থেকে এক ব্যাক্তির নামে একাধিক কৃষি লোন, এফডিআর এর লোনের ক্ষেত্রে সকল ডকুমেন্ট না রেখে লোন প্রদান, নিয়ম বহিরভুত ভাবে একটি এফডিআর এ্যকাউন্ট এর বিপরীতে একাধিক ঋণ প্রদান, বিভিন্ন নামে-বেনামে ও লোনসহ নানা অনিয়মের প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
আর এসব অনিয়ম তদন্তে বর্তমানে শাখাটিতে চলছে অডিট। এখন পর্যন্ত তিন দফা অডিটে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে বলে বাগেরহাট ইনফো ডটকামকে জানিয়েছে ব্যাংক সংশ্নিষ্ট একটি সূত্র।
সূত্রটি জানায়, সহজ শর্তে কৃষি লোনের নামে অগ্রনী ব্যাংকের বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার গোয়ালমাঠ শাখা হতে চলতি বছরের ৩১ শে মার্চ পর্যন্ত স্বনির্ভর বাংলাদেশ নামে এনজিও’র মাধ্যমে ১ কোটি ৭৭ লক্ষ ৫৬ হাজার ৮শত ১৩ টাকা বিতরণ করে। যার অধিকাংশ এনজিও প্রতিষ্ঠান স্বনির্ভর এর ক্রেডিট ম্যানেজার সরদার আলমগীর হোসেন অনান্যদের সহায়তায় এবং অনান্য সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে আত্মসৎ করেছেন।
সূত্রটি আরো জানায়, চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারী ব্যাংকের গোয়ালমাঠ শাখার ব্যবস্থাপক এমদাদ হোসেনের অবসর প্রস্তুতি জনিত (পিআরএল) ছুটিতে গেলে ওই নতুন শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব দেওয়া হয় মলয় কিশোর বিষ্ণ কে। নিয়ম অনুসারে নুতন শাখা ব্যবস্থাপককে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবার কথা থাকলেও পি আর এল ছুটিতে যাওয়া এমদাদ হোসেন ঋণ ও অন্যান্য বিভাগের ডকুমেন্ট বর্তমান ব্যবস্থাপককে বুঝিয়ে দিতে পারেন নি।
এক পর্যায়ে ডকুমেন্টসহ সমস্ত লেজার সুষম করার সময়ে ঋনের টাকা বিতরণের অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয়।
প্রথমে স্বনির্ভরের কৃষি লোনের ক্ষেত্রে এ অনিয়ম ধরা পড়লেও পরে একে একে অন্যান্য ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানেও নানা অনিয়মের প্রমাণ মেলে।
ঠিক কত টাকার গড়মিল তা সঠিক ভাবে জানতে পরছেন না কেউই! তবে এ পর্যন্ত শুধু মাত্র স্বনির্ভরের কৃষি লোনেই প্রায় ৩০ লাখ টাকার গড়মিল পাওয়া গেছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
বাগেরহাট ইনফোর অনুসন্ধানে জানা যায়, এনজিও প্রতিষ্ঠান স্বনির্ভর বাংলাদেশে চাকুরির সুবাদের এই ব্যাংকে বসার সুযোগ পায় প্রতিষ্ঠানটির মোড়েলগঞ্জ-কচুয়া উপজেলার ক্রেডিট ম্যানেজার আলমীর হোসেন। এই আলমগীর হোসেন এক সময়ে বনে যায় “ব্যাংকের কর্মকর্তা”। তার ভাব-ভঙ্গিতে সবাই মনে করত সে এই ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। ব্যাংকের সব কাজেই শুরু হয় তা হস্তক্ষেপ।
বিশেষ করে স্বনির্ভরের ঋণ কার্যক্রম ছাড়াও ব্যাংকের ঋণের কার্যক্রম তার হাত দিয়েই হতো। তবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি, ব্যাংকে ঋণ কার্যক্রমের লোক না থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে সে লোনের কাজও করত।
আর ব্যাংকের এসব কার্যক্রমে নিজের অংশগ্রহনের মাধ্যমে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছে ওই আলমগীর হোসেন।
তবে ব্যাংকে নতুন ব্যবস্থাপক দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই ব্যাংকে অনিয়মিত হতে থাকেন স্বনির্ভরের ওই ক্রেডিট ম্যানেজার। আর ৩১ মার্চ থেকে চলে যান আত্মগোপনে। এর পর কয়েক দফা তাকে ব্যাংকে এসে সব হিসাব বুঝিতে দিতে স্বনির্ভরের জেলা এরিয়া ম্যনেজার এবং অভিযুক্ত ওই ব্যক্তিকে নোটিশ দেয়া হলেও ব্যাংকে আসেন নি তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, হিসেবে গড়মিল থাকার কারণে ১০ মার্চ শাখা ব্যাবস্থাপক মলয় কিশোর অগ্রনী ব্যাংকের বাগেরহাট জোনাল শাখায় জানায়। এর পর ১৮ মার্চ শুরু হয় অডিট। অডিট টিম ৭ এপ্রিলের মধ্যে স্বনির্ভর লোন ডকুমেন্টস সহ সমস্ত লোন লেজার সমুহ সুষম করতে নির্দেশ দেয়। সুষম না করায় ব্যাংক ব্যবস্থাপক ৮ এপ্রিল স্বনির্ভর -কে চিঠি দেয়। এর আগে ৬ এপ্রিল স্বনির্ভার বাংলাদেশের বাগেরহাট এরিয়া ম্যানেজার সরদার আলমগীর হোসেনকে চিঠি দেয়।
যাতে বলা হয়, ১০ এপ্রিলের মধ্যে সে উপস্থিত না হলে তার ব্যাপারে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্ত এখন পর্যন্ত কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি।
অডিট টিম যে সব অসামঞ্জস্য পেয়েছে তা হল, এফডিআর লোন এর ক্ষেত্রে সকল ডকুমেন্টস পাওয়া যায় নি, একই ব্যক্তির নামে একাধিক কৃষি লোনের অস্তিত, দীর্ঘদিন লেজার সুষম না হওয়া স্বনির্ভর লোনের ডকুমেন্টস সহ লেজার সুষম না হওয়া প্রভৃতি।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক ব্যক্তি জানান, তারা স্বনির্ভরের লোনের টাকা ব্যাংকে গিয়ে আলমগীরের কাছে দিয়ে আসলেও এখন জানতে পারছেন তাদের লোন পরিষোধ হয় নি। তাদের নামে একাধিক লোন রয়েছে। তারা জানান, তারা আলমগীর ও তার বাহিনীর ভয়ে অনেকই মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছে।
ব্যাংকের এক ব্যক্তি জানান, অনেকে ব্যাংকে এসে টাকা জমা দেয়ার রশিদ দেখাচ্ছেন। তাতে আলমগীরের হাতের লেখা রয়েছে। কিন্তু রশিদ থাকলেও তাদের টাকা জমা হয় নি।
এ ব্যাপারে স্বনির্ভরের ওই ক্রেডিট ম্যানেজার সরদার আলমগীর হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
আর স্বনির্ভর বাংলাদেশ এর এরিয়া ম্যানেজার (বাগেরহাট) এ, কে. এম নজরুল ইসলাম এর কাছে এব্যাপারে জানতে চাইলে বাগেরহাট ইনফো ডটকামের কাছে প্রথকে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেন। পরে অবশ্য তাদের ঋণ কার্যক্রমে অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত হচ্ছে বলে স্বীকার করেন।
এদিকে শাখাটিতে কৃষি লোন ছাড়াও অনান্য ঋণের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আত্মসতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আঞ্চলিক কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বাগেরহাট ইনফো ডটকামকে জানান, এখন পর্যন্ত অডিতে এটি এফডিআর এ্যাকাউন্ট এর বিপরিতে ৪টি ঋণ দেওয়ার মতন নজির বিহীন ঘটনা প্রমান পাওয়া গেছে শাখাটিতে।
অন্যদিকে শাখাটিতে এধরনের অনিয়ম এবং অর্থ আত্মসতের কথা আসতে আসতে প্রকাশ পেতে থাকায় এখানে আমানত রাখা অনেক গ্রাহক হতাশ হয়ে ছড়েছেন। কোন কোন গ্রাহক তুলে নিচ্ছেন তাদের আমানত।
এছাড়া বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন সময় প্রভাবশালী মহলে দৌড় ঝাপের পাশাপাশি এবিষয়ে কোন প্রকার তথ্য প্রদান করলে তাদে দেখে নেওয়ার হ্যুমকিও দেওয়া হচ্ছে। আর এ সুযোগে নাম ধারি কিছু সংবাদ কর্মী চক্রটির কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা গহন করেছেন বলে উঠে এসেছে বাগেরহাট ইনফোর অনুসন্ধানে।
এ ব্যাপারে বাগেরহাট অগ্রনী ব্যাংকের আঞ্চলিক সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. আনোয়ার হোসেন বাগেরহাট ইনফোকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী এই ধরনের দূর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাত করেছে। এমন খবর পেয়ে ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার দিলিপ কুমার মন্ডল, আব্দুল মালেক ও আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত টীম গঠন করা হয়েছে।
এই তদন্ত টীমের প্রতিবেদন পাওয়ার পরই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
তবে দির্ঘ্য দিন ধরে এসব অনিয়ম হয়ে আসলেও আঞ্চলিক কিছুই বুঝতে বা জানতে না পারার কারণ সম্পার্কে কোন সদউত্তর দিতে পারে নি তিনি।