আবু হোসাইন সুমন, মংলা:
খালের বাঁধ অপসারণের ফলে লবণ অধ্যুষিত মংলা এলাকার জমিতে প্রায় ৩ দশক আগে হারিয়ে যাওয়া ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে এবার। কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসির ঝিলিক।
মংলায় সরকারি প্রায় ১০৮টি খাল রয়েছে। এসব খালের অধিকাংশতে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তি বাঁধ দিয়ে লবণ পানি আটকে চিংড়ি ঘের (মাছ চাষ) করে আসছিল। আর এ মাছ চাষে দীর্ঘ সময় লবণ পানি আটকে থাকায় এখানকার জমি হয়ে পড়ে লবণাক্ত। লবণাক্ততার প্রভাবে এ এলাকার জমিতে আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেতে থাকে ধানের ফলন। এ প্রেক্ষিতে এলাকাবাসীর আন্দোলনের মুখে ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে সরকারী ৩২ টি খালের বাঁধ কেটে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বাঁধ অপসারণের এক বছরের মাথাতেই লবণ পানি আটকে না থাকায় এ এলাকার অনেক জমিতেই জমির মালিকেরা এবার ধানের বাম্পার ফলন পেয়েছেন।
সরেজমিনে মংলার কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে বিল ভর্তি পাকা ধান। জমির মালিকের মুখে হাসি। পৌরসভাধীন মাছমারা গ্রামের পিটার বিধূ দাশ (৭৮) বলেন, মাছমারা বিলের মাছমারা, মাকড়ঢোন, পেড়িখালী, নারকেলতলা, চাঁদপাই ও কুমারখালী গ্রামের জনগনের প্রায় ১শ ২৫ একর জমি রয়েছে। ২২ বছর ধরে আমরা আমাদের জমির ফসল থেকে বঞ্চিত ছিলাম। এই এলাকা এমনিতেই লবনাক্ত। তারপর এই বিলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত খালে বাঁধ থাকার কারণে আমরা এর আগে তেমন কোন ফসল পাইনি। গত বছর উপজেলা প্রশাসন খালের বাঁধ উন্মুক্ত করে দেওয়ায় আমরা এবার ধানের সুন্দর ফলন পেয়েছি।
মালগাজী গ্রামের মার্টিন ঘোষ, জন বিশ্বাস, মহানন্দ বিশ্বাস সহ আরো কয়েক গ্রামবাসী জানান, সরকারী খাল উন্মুক্ত রাখতে পারলে জোয়ার-ভাটার কারণে জমিতে স্বাভাবিক ভাবেই নদীর পলি পড়ে। এতে করে জমিতে ধান হয়। কিন্তু খাল বদ্ধ করে জমিতে লবণ পানি আটকে রাখলে ধান একেবারেই হয় না। গত ২০-২২ বছর ধরে আমদের এলাকা একদম শস্যহীন হয়ে পড়েছিল। আমরা কখনোই আমাদের জমিতে আর লবণ পানি আটকে রাখতে দিব না। ভবিষ্যতে কেউ এভাবে যাতে জোর করে খালে বাঁধ দিয়ে লবণ পানি আটকে তাদের জমি নিয়ে চিংড়ি চাষ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তারা।
চাঁদপাই স্কুলের ব্রীজ সংলগ্ন বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম, আক্কাস আলী, গৃহবধূ আয়েশা বেগম, মরিয়ম খাতুন বলেন, খালের বাঁধ অপসারণের ফলে আমরা বিঘাপ্রতি ২০-২৫ মন ধান পেয়েছি। আমাদের জমিতে অন্যরা চিংড়ি চাষ করতো। আর আমাদের ফসলের অভাবে চাল কিনে খেতে হতো। এছাড়া জমিতে সারা বছর লবণ পানি আটকে না থাকার ফলে আমাদের গবাদি পশুগুলোর খাদ্যের অভাবও পূরণ হচ্ছে। ষাটোর্ধ্ব বীনা হালদার বলেন, খাল উন্মুক্ত থাকলে প্রাকৃতিক ভাবে যে মাছ খালে পাওয়া যায়, সে মাছ ধরে এই এলাকাসহ আশপাশের ৪-৫ হাজার গরীব মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে।
এদিকে গত বছর প্রশাসনের উন্মুক্ত করা খালের মধ্যে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি খাল প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পুনরায় বাঁধ দিয়ে লবণ পানি আটকে চিংড়ি চাষ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে করে ওই সব এলাকাতে এবারও তেমন ধানের ফলন হয়নি।
মংলা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মোঃ নুর আলম শেখ জানান, লবণ পানি অধ্যুষিত মংলায় চিংড়ি চাষের পাশাপাশি ধানের ফসল পাওয়ার জন্যে জমির মালিকদের উচিত সারা বছর লবণ পানি জমিতে আটকে না রাখা। তিনি সব খালই উমুক্ত করার জন্য দাবি জানান।
এ ব্যাপারে মংলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পরিবেশবিদ ড. মিজানুর রহমান বলেন, গত বছর বেশ কিছু সরকারী খালের বাঁধ অপসারণ করতে গিয়ে প্রভাবশালী বিভিন্ন ব্যক্তির রোষানলে পড়তে হয়েছিল। তার পরও এলাকার উন্নয়নে প্রভাবশালীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে খালের বাঁধ উমুক্ত করে দেয়ায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এখানকার সব সরকারী খালের বাঁধ অপসারণে প্রক্রিয়া চলছে।