এমটিটি (মডিফাইড ট্র্যাডিশনাল টেকনোলজি) অর্থাৎ উন্নত সনাতন চাষ কৌশল বা পরিবতিত সনাতন চাষ কৌশল। এমটিটি চিংড়ি চাষ কৌশলটি সনাতন চাষ এবং ভাল চাষ ব্যবস্থাপনা কৌশল (বিএমপি) এর চেয়ে উন্নত, আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক কৌশলের সমন্বয়ে বাস্তবায়িত একটি ঝুঁকি বিহীন টেকসই চিংড়ি চাষ কৌশল।
২০০৬ সাল হতে ওয়ার্ল্ড ফিস, বাংলাদেশ সফলভাবে এমটিটি চিংড়ি চাষ কৌশল বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার চাষীদের মাঝে কারিগরি সহযোগীতা, প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রদর্শণী পুকুরের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে সফলভাবে চিংড়ি উৎপাদন করছে। বাগদা চিংড়ি চাষের মূল সমস্যা হচ্ছে ভাইরাস-এই পদ্ধতিতে কৌশলের পাশাপাশি পিসিআর পরীক্ষিত বাগদা চিংড়ির ভাইরাসমুক্ত পোনা মজুদ করা হয়, মজুদ ঘনত্ব সীমিত রাখা হয় এবং প্রতিদিন নিয়মিত গুণগত মান সম্পন্ন খাদ্য প্রয়োগ করা হয়।
চিংড়ি চাষের জন্য দু’টি পুকুরের প্রয়োজন হয়। একটি চাষ পুকুর এবং অন্যটি নার্সারী পুকুর। সাধারণতঃ চাষ পুকুরের আয়তনের ১০-১৫ শতাংশ আয়তন বিশিষ্ট নার্সারী পুকুর হয়। ধরা যাক চাষ পুকুরের জলায়তন ১০০ শতক। সেক্ষেত্রে নার্সারী পুকুরের জলায়তন হবে ১০-১৫ শতক।
নার্সারী পুকুরের পাড় শক্ত মজবুত, দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত করা হয় যেন বাইরে থেকে দূষিত পানি ও রোগ জীবানু ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। শুধু নার্সারী পুকুরটির পাড় উঁচু নেট দ্বারা ঘিরে দেওয়া হয় যেন বাইরে থেকে সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া, কুঁচে, কুকুর, বিড়াল বা মানুষ নার্সারীতে সহজে প্রবেশ করতে না পারে। পোনার মৃত্যুর ঝুঁকি এবং রোগবালাই প্রতিরোধের জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বায়ো সিকিউরিটি (Bio-Security) বা জীব নিরাপত্তা বা জৈব নিরাপত্তা বলা হয়।
নার্সারী পুকুরটি নিয়ম মোতাবেক চুন, সার প্রয়োগ করে প্রস্তুত করা হয়। অত:পর ঘন ফাঁসের নেট দিয়ে ছেকে পানি প্রবেশ করানো হয়,পানির গভীরতা ৪-৫ ফুট বজায় রাখা হয়। পানি প্রবেশের ৪-৫ দিন পর ৬০ পিপিএম হারে পানিতে ব্লিচিং প্রয়োগ করে জীবানুমুক্ত করা হয়। ব্লিচিং প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর চুন, সার, চিটাগুড়, পালিশকুঁড়ো ও ইষ্ট পাউডার প্রয়োগে প্রাকৃতিক খাবার তৈরী করা হয়।
পানির বিষাক্ততা পরীক্ষার পর নার্সারী পুকুরে রোগমুক্ত সুস্থ সবল পোনা মজুদ করা হয়। চাষ পুকুর সঠিকভাবে চুন সার দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। চাষ পুকুরে সাধারণত: ব্লিচিং প্রয়োগ করা হয় না। তবে ১০ পিপিএম হারে ব্লিচিং প্রয়োগ করলে রোগ জীবানু ধ্বংস হয়ে যায় এবং ভাল ফল পাওয়া যায়। নার্সারী পুকুরে প্রতিশতকে ৫০০-৬০০ টি পোনা মজুদ করা হয় এবং পোনা মজুদের ২৫ দিন পর হতে পোনা আহরণ শুরু হয়।
চাষ পুকুরে গণনা করে পোনা মজুদ করা হয় এবং প্রতিশতকে ৫০-৬০টি, ২৫-৩৫ দিন বয়সের কিশোর চিংড়ি মজুদ করা হয়। পোনা মজুদের দিন হতেই প্রতিদিন নার্সারী ও চাষ পুকুর উভয় স্থানে গুণগতমান সম্পন্ন ৪০-৪৫ % প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য প্রয়োগ করা হয়। নার্সারী পুকুরে চিংড়ি পোনার বাঁচার হার ৮০-৮৫ % হয়ে থাকে এবং চাষ পুকুরে মজুদকৃত কিশোর চিংড়ির পোনার বাঁচার হার ৯০-৯৫ % হয়ে থাকে। নার্সারী পুকুরে ৬০০০টি পোনা মজুদ করা হলে, ৪৮০০-৫০০০টি কিশোর চিংড়ি চাষ পুকুরে (১০০ শতক) মজুদ করা যাবে এবং ৯০-১১০ দিন পর ৩৩-৩৫ গ্রাম ওজনের চিংড়ি আহরণ করা যায়।
এক্ষেত্রে নার্সারীতে ৩০-৩৫ দিন এবং চাষ পুকুরে ৯০-১১০ দিন, চাষের মেয়াদ কাল হবে ১২০-১৪০ দিন। চিংড়ির সম্ভাব্য উৎপাদন হবে প্রতি ফসলে ১৫০-১৬০ কেজি। বৎসরে ৩-৪ বার পোনা মজুদ করা যায়। বিগত কয়েক বৎসরের এমটিটি চাষের ফলাফলে ৪৫০ কেজি থেকে ৬৫০ কেজি চিংড়ি প্রতি বৎসর প্রতি একরে উৎপাদন হয়েছে।
বছরের শুরুতে ১৫ ফেব্রুয়ারী হতে ১লা মার্চের মধ্যে প্রথমবার, ১লা মে-এর মধ্যে দ্বিতীয়বার, ১লা জুলাই এর মধ্যে তৃতীয়বার সহজেই তিনবার পুকুর প্রস্তুত করে পোনা মজুদ করা যায়। অনেক চাষী ৪-৫ বার পোনা মজুদ করে থাকেন। কোন কোন চাষী চাষ পুকুরে পানির গভীরতা পর্যাপ্ত পরিমাণ থাকলে প্রথমবারেই বেশী করে পোনা মজুদ করে ৮-৯ মাস পর একবার চিংড়ি আহরণ করেন।
এমটিটি পদ্ধতি চিংড়ি চাষে ২০১৩ সালে প্রতিকেজি চিংড়ির (৩৩-৩৫ গ্রাম প্রতিটি চিংড়ি ৩০-২৮ পিচে কেজি) উৎপাদন ব্যয় হয়েছে (পুকুর প্রস্তুত হতে বিক্রি পর্যন্ত) ৩৩০-৩৫০ টাকা এবং প্রতি কেজি চিংড়ি বিক্রি হয়েছে ৮০০-৮৫০ টাকা। প্রতি একরে সর্বনি¤œ উৎপাদন ৪৫০ কেজি হলে বৎসরে কমপক্ষে দুইলক্ষ টাকা শুধু চিংড়ি থেকে লাভ করা যায়। গলদা চিংড়ি ও অন্যান্য সাদা মাছ থেকে চাষীরা প্রতি একরে বৎসরে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রকৃত মুনাফা করে থাকেন।
এমটিটি কৌশলে প্রথমবারের চিংড়ি চাষে ব্যয় হয় ৬০,০০০-৭০,০০০ টাকা। প্রথমবার চিংড়ি আহরণের পর হতে, চিংড়ি বিক্রির টাকা থেকে ব্যয় নির্বাহ করা যায়। বর্তমানে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন বৎসরে ১৫০-১৮০ কেজি প্রতি একরে। অপরদিকে এমটিটি চাষে উৎপাদন ৪৫০-৬৫০ কেজি প্রতি একরে। চাষীকে প্রশিক্ষণ, নিয়মিত কারিগরি সহযোগীতা এবং ঋণ হিসাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান ।
পাশাপাশি পিসিআর পরীক্ষিত পোনা, গুণগত মান সম্পন্ন খাদ্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করা হয় তবে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন বর্তমান উৎপাদনের দ্বিগুণ করা সম্ভব খুব সহজেই।
» মো: নাজমুল আলম
সিনিয়র টেকনিক্যাল স্পেশিয়ালিষ্ট
এ্যাকুয়াকালচার ফর ইনকাম এন্ড নিউট্রিশন প্রকল্প
ওয়ার্ল্ডফিস, খুলনা-বাংলাদেশ।