প্রচ্ছদ / আরও... / বাগদা চিংড়ির নার্সারির গুরুত্ব ও নার্সারি তৈরীর কৌশল

বাগদা চিংড়ির নার্সারির গুরুত্ব ও নার্সারি তৈরীর কৌশল

কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মস্যখাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর চিংড়ি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি মস্যপণ্য। আন্তর্জাতিক বাজাওে চিংড়ির চাহিদা বৃদ্ধিও সাথে সাথে এ দেশের উপক’লীয় অঞ্ছলে চিংড়ি খামাওে আধুনিক চাষ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন ও পিএল নার্সারিতে নার্সিংয়ের মাধ্যমে ঘেওে জুভেনাইল মজুদের বিষয়ে চাষি পর্যায়ে সচেতনা বৃদ্ধিও উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।

ওয়ার্ল্ডফিশ-বাংলাদেশ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ইউএসএইড-এআইএন প্রকল্প ২০১২ সাল হতে চিংড়ি খামারে আধুনিক চাষ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন ও পিএল নার্সারিতে নার্সিংয়ের মাধ্যমে ঘেরে জুভেনাইল মজুদের বিষয়ে চাষি পর্যায়ে ব্যপক কাজ করে আসছে।

বাগদা চিংড়ির নার্সারি করার গুরুত্ব :
বাগদা পিএল ২০-২৫ দিন নার্সারিতে লালন-পালন করে ঘেরে ছাড়া হলে-

  • পিএল-এর সঠিক পরিচর্যা এবং খাবার দেওয়া সহজ হয়
  • ঘেরের পরিবেশের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে
  • পিএল সঠিকভাবে বৃদ্ধি পায় ও সবল হয়ে ওঠে
  • বেঁচে থাকার হার বৃদ্ধি পায়
  • মজুদ ঘেরে সঠিক মাত্রায় জুভেনাইল মজুদ করা যায়
  • সর্বোপরি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

বাগদা চিংড়ির নার্সারি ব্যবস্থাপনা কৌশল:

  • বাগদা চিংড়ির নার্সারির স্থান ও আকার :
    ঘেরের ভিতরে যেকোনো এক পার্শ্বে ক্যানেল/নালা করে অথবা বাইরে কাছাকাছি বা দূরে পুকুরের মতো বাঁধ (বেড়ি) দিয়ে নার্সারি তৈরি করতে হবে। ঘেরের আকার হবে মুল ঘেরের ১০% অর্থাৎ প্রতি ১০০ শতাংশ মূল ঘেরের জন্য ১০ শতাংশ নার্সারি।
  • চিংড়ির নার্সারির পাড় মেরামত এবং তলার পচা কালো কাদা অপসারণ:
    শীত/বসন্তকালে পুরাতন নার্সারি হলে সেচ দিয়ে পানি শুকিয়ে তলার কালো ও পচা কাদা তুলে পাড় ভালোভাবে মেরামত করতে হবে।

নার্সারিতে জৈব নিরাপত্তা বজায় রাখা :
ঘেরের বাইরে থেকে ঘেরের ভিতরে যে কোনো ধরনের প্রাণী; যেমন-সাপ, ব্যাঙ, পোকা-মাকড় বা অন্য কোনো প্রাণীর প্রবেশ বন্ধ করে ঘেরের চিংড়ি ও মাছকে রক্ষা করাকেই জৈব নিরাপত্তা বলা হয়। ঘেরে চুন প্রয়োগের পূর্বে ঘনফাঁসের নীল নেট ৬ ইঞ্চি মাটির নিচে গভীর করে ঢুকিয়ে দিয়ে সমস্ত ঘেরটি ঘিরে দিতে হবে।

  • রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ দূরীকরণ : ৩টি পদ্ধতিতে ঘের থেকে রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ দূর করা যায়। যথা-

ক) পুকুর শুকিয়ে খ) ঘন ফাঁসের জাল টেনে এবং গ) টি-সিড কেক ব্যবহার করে; প্রতি শতাংশে ৫৫০-৭০০ গ্রাম ৩-৫ ফুট গভীরতার জন্য, প্রয়োজনীয় পরিমাণ টি-সিড কেক একটি পাত্রে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে সকাল রেলা সূর্য্য ওঠার পর রৌদ্রজ্জ্বোল আবহাওয়ায় প্রয়োগ করতে হবে।

নার্সারি প্রস্তুতকালীন চুন প্রয়োগ : নার্সারি প্রস্তুতের সময় পোড়া চুন (দেখতে পাথরের ন্যায়) প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে দিতে হবে।

নার্সারিতে পানি উত্তোলন: বাগদার ক্ষেত্রে সাধারণত জোয়ারের সময় নার্সারিতে ক্যানেল বা খালের পানি ঢুকানো ভালো। পানি ঢুকানোর পথে ছাঁকুনিটি ঘন ও দুই স্তর বিশিষ্ট হতে হবে। ১ম ছাঁকুনির মেস সাইজ ১.৫ মিমি এবং ২য় টির ফাঁস ০.৫ মিমি হতে হবে। ছাঁকুনির বাহিরে একটি নিরাপত্তা বানার ব্যবস্থা থাকলে মূল ছাঁকুনি টেকসই হবে।
থিতানো: নার্সারিতে পানি উত্তোলনের পর কমপক্ষে ৩ দিন অপেক্ষা করতে হবে।
পানি শোধন: নার্সারিতে পানি ঢুকানোর ৩ দিন পর প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট পানির জন্য ১ কেজি হারে ব্লিচিং পাউডার দ্বিগুণ পরিমাণ পানির সাথে মিশিয়ে রাত ৮-৯ টার সময় নার্সারিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।

নার্সারিতে মজুদ পূর্ব সার প্রয়োগ, প্রয়োগ পদ্ধতি ও সময় :
চুন প্রয়োগের ৩-৫ দিন পর এবং পিএল ছাড়ার কমপক্ষে ৪-৫ দিন পূর্বে প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম চিটাগুড়, ১০০ গ্রাম অটোপালিশ এবং ১ চা চামচ ইস্ট আগের দিন একত্রে মিশিয়ে দ্বিগুন পরিমাণ পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে ছেঁকে শুধু দ্রবনটুকু ঘেরের পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে। এভাবে একই চিটাগুড় ও অটোপালিশের মিশ্রণটি পর পর দুইবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হবে। প্রতি শতাংশ ৫০-১০০ গ্রাম সরিষার খৈল আলাদা ভাবে ১২-১৪ ঘন্টা পূর্বে ভিজিয়ে রেখে পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।
চিংড়ির আশ্রয়স্থল তৈরি : চিংড়ি যখন খোলস পরিবর্তন করে তখন খোলস পরিবর্তনকারী বা দূর্বল চিংড়ি ও ছোট চিংড়িগুলো রক্ষার জন্য নার্সারিতে প্রতি শতাংশে ১-২টি শুকনো নারিকেল বা তালপাতা অথবা ৮-১০টি কঞ্চি হালকাভাবে বেঁধে পানিতে স্থাপন করা যেতে পারে।

নার্সারির প্রাকৃতিক খাদ্য ও পানির উপযুক্ততা পরীক্ষা এবং ক্ষতিকর জলজ পোকা-মাকড় দমন –
তিন ভাবে নার্সারির প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা করা যায়-

  • হাত দিয়ে প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষা
  • গামছা-গ্লাস/ ছাকনি-গ্লাস প্রাকৃতিক খাদ্য দিয়ে পরীক্ষা ও
  • সেকি ডিস্ক এর সাহায্যে।

নার্সারির পানির উপযুক্ততা পরীক্ষা : নার্সারিতে একটি হাপা স্থাপন করে তাতে ৮-১০ টি পিএল মজুদ করে ৪-৫ ঘন্টা রেখে পানির উপযুক্ততা পরীক্ষা করতে হবে। ৪-৫ ঘন্টা পর যদি পিএল সুস্থ ও বেঁচে না থাকে তবে বুঝতে হবে পানিতে উপযুক্ততা নাই। যদি বেঁচে না থাকে তাহলে কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে।

নার্সারির ক্ষতিকর জলজ পোকা-মাকড় দমন :
জলজ পোকা যেমন- হাঁস পোকা, ড্রাগন ফ্লাই নিম্ফ, মাখন পোকা দমনের জন্য প্রতি শতাংশে ১২৫ মিলি কেরোসিন বা ১০০ মিলি ডিজেল ছিটিয়ে দিতে হবে এবং ছিটিয়ে দেয়ার ১ ঘন্টার মধ্যে ঘন ফাঁসের জাল দিয়ে তুলে ফেলতে হবে।

পিএল অভ্যস্তকরণ ও মজুদ :
পিএল ভর্তি পলিথিন ব্যাগ আধা ঘণ্টার মতো নার্সারির পানিতে ভাসিয়ে রাখতে হবে। তারপর কমপক্ষে ৩০-৪০ মিনিট ধরে পানি অদল-বদল করে ধীরে ধীরে লবণাক্ততা ও তাপমাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। চিংড়ির পিএল অভ্যস্তকরণের সময় প্রতি ৩০ মিনিটে ২-৩ পিপিটি লবণাক্ততা পার্থক্য দূর করা যায়। নার্সারির অপেক্ষাকৃত গভীর স্থানটিতে পলিব্যাগের মুখ খুলে কাত করে অর্ধেক মুখ ডুবিয়ে পানিতে মৃদু স্রোতের সৃষ্টি করলে পিএল স্বেচ্ছায় ঘেরের পানিতে চলে যাবে।

পিসিআর পরীক্ষিত / এসপিএফ বাগদা পোনা মজুদের গুরুত্ব : ঘের প্রস্তুতি হতে শুরু করে যাবতীয় কার্যাবলী নিখুতভাবে সম্পন্ন করার পরেও চিংড়িতে ভাইরাস আক্রমণ হতে পারে যদি পিসিআর পরীক্ষিত/এসপিএফ পিএল ঘেরে মজুদ করা না হয়। কারণ যেকোনো পিএল এ ভাইরাস থাকতে পারে। তাই চিংড়ি চাষিকে অবশ্যই পিসিআর পরীক্ষিত/এসপিএফ বাগদা পিএল মজুদ করা উচিত।

মজুদ ঘনত্ব :
নার্সারিতে পিএল এর মজুদ ঘনত্ব প্রতি শতাংশে ১,০০০-১,২০০টি ।
পিএল বেঁচে থাকার হার পর্যবেক্ষণ: চিংডি নার্সারির মধ্যে একটি বড় হাপা স্থাপন করে তাতে ১০০টি পিএল দিয়ে ৭২ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত যতোগুলো পিএল বেঁচে থাকবে সেই অনুপাতে নার্সারিতে পিএল বেঁচে আছে বলে ধরা হয়।

বাগদা পিএল’র সম্পূরক খাদ্য প্রয়োগ:
বাগদা চিংডির নার্সারিতে দিনে চার বার ( ভোর ৬ টায় ২০%, ১১ টায় ২০%, বিকাল ৫ টায় ২৫% ও রাত ৯ টায় ৩৫% ) খাবার প্রয়োগ করা উচিত। চিংডির দেহ ওজনের ২০-১০% খাবার দৈনিক নার্সারিতে প্রয়োগ করতে হবে।

খাদ্য প্রয়োগ পদ্ধতি :
Bagda-Chingri-Pic003পরিমাণমতো খাবার দৈনিক ঘেরের নির্দিষ্ট স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে অথবা ফিডিং ট্রে স্থাপন করেও খাবার দেওয়া যেতে পারে। ফিডিং ট্রে স্থাপন করে খাবার দেওয়া উত্তম।

ইউএসএইড-এআইএন প্রকল্প হতে মাঠ পর্যায়ে কাজ কওে দেখা গেছে যে, উপরোক্ত পদ্ধতিতে নার্সারিতে পিএল লালন-পালন করলে পিএল এর বাঁচার হার ৬০-৮০% হয়ে থাকে।

লেখক:
এবিএম শাহিদুল হক,
টেকনিক্যাল স্পেশালিষ্ট, ওয়ার্ল্ডফিশ – বাংলাদেশ,
বাগেরহাট। মোবাইল: ০১৭১২-৫৪০৭৬০

– বিজ্ঞপ্তি

About ইনফো ডেস্ক