মাছ চাষের ক্ষেত্রে রেনু পোনাকে ছোট জলাশয়ে প্রতিপালন করে অপেক্ষাকৃত বড় জলাশয়ে বা পুকুরে ছেড়ে মাছ চাষ করা হয়। যে সকল ছোট পুকুরে বা জলাশয়ে রেনু পোনা বা ধানী পোনা অতি যত্ন সহকারে পালন করা হয় তাকে আতুর পুকুর বা নার্সারি পুকুর বলে।
মাছের রেনু বা ধানী পোনা প্রয়োজনীয় পরিচর্যার মাধ্যমে লালন পালন করে মজুদ পুকুরে ছেড়ে চারা পোনায় উন্নীত করার পদ্ধতিকে নার্সারি ব্যবস্থাপনা বলে। অর্থনৈতিক দিক থেকে নার্সারী ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় নার্সারি পুকুর ব্যবস্থায় উন্নত পদ্ধতি অনুসরন করা প্রয়োজন। ৩-৫ দিনের রেণু ছেড়ে পোনা তৈরী করাকে নার্সারি বলে।
পোনা চাষে পুকুরের বৈশিষ্ট্য/নার্সারি পুকুরের বৈশিষ্ট্যঃ
যে কোন অগভীর, বাৎসরীক বা মৌসুমি পুকুরকে মাছের পোনা প্রতিপালনের জন্য নার্সারি পুকুর হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে আতুর পুকুর ছোট হওয়ায় ভাল।
কার্প জাতীয় মাছের পোনা প্রতিপালনের উপযোগী নার্সারি পুকুরের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো – পুকুরটি হবে খোলামেলা, ভালো যাতায়েত ব্যাস্থা, উত্তর- দক্ষিন লম্বা হলে ভাল হয়, আয়তন ১০-২৫ শতাংশ, পানির গভীরতা ২.৫- ৩ ফুট, দো-আশ, পলি দো-আশ বা এটেল দো-আশ মাটি, তলদেশে কাদার বেশী না হওয়ায় ভাল, জলজ আগাছা না থাকা, বন্যা মুক্ত শক্ত ও উচু পাড়, পড়ে গাছ বা ঝোপঝাড় না থাকা, পানি নিষ্কাশন ও সরবরাহ ব্যবস্থা থাকা প্রভৃতি।
নার্সারি ব্যবস্থাপনাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ ক) আতুর পুকুর ব্যবস্থাপনা; খ) কাটাই বা লালন পুকুর ব্যবস্থাপনা
ক) আতুর পুকুর ব্যবস্থাপনাঃ আতুর পুকুরে সাধারনত ১০-১৫ দিন রেণু পোনা লালন পালন করা হয়। এই পুকুরে সঠিক ব্যবস্থাপনার উপর মাছের পোনা বাঁচার হার এবং বৃদ্ধি নির্ভর করে।
ক) আগাছা ও পাড় পরিস্কারঃ নার্সারি পুকুর পাড়ের আগাছা পরিস্কার করতে হবে এতে বেশী আলো পড়ে
– পোনার প্রাকৃতিক খাদ্য বেশী তৈরী হয়
– পোনা উৎপাদন বেশী হয়
– মাঘ-ফাল্গুন- চৈত্র মাসে এ কাজটি করতে হবে।
খ) পুকুরের পাড় মেরামত ও তলা সংস্কার ঃ-
– প্রতি বছর নার্সারি পুকুর শুকানো ভাল
– পুকুর শুকানোর পর ভাঙ্গা পাড় উচু,মজবুদ,এবং ছিদ্রবিহীন ভাবে মেরামত করতে হবে
– অতিরিক্ত কাদা তুলে ফেলে অসমান তলদেশ সমান করতে হবে
– শুকানোর পর তলায় চাষ দিতে হবে
– পুকুর পাড়ের ঢাল ১ঃ২ হতে হবে
পুকুরের পাড় ও তলা সংস্কারের উপকারিতাঃ –
– মাটি চাষ দিলে মাটির বাধন আলগা হয় তাতে সূর্যের আলো মাটির গভীরে প্রবেশ করার ফলে রোগ জীবানু মারা যায় এবং মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে
-পুকুরের মাটি ও পানির গুনাগুন ভাল থাকে
– তলার বিষাক্ত গ্যাস দূর হয়
– পোনা মাছ আহরনের সময় জাল টানা সহজ হয়
– পুকুরের পাড় মেরামত ও উচু হলে রেণুপোনার চাষ এবং পরিচর্যা সহজ হয়
– বাইরের দূষিত পানি ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না
– বাইরের রাক্ষুসে ও অচাষকৃত প্রজাতীর মাছ পুকুরে ঢুকতে পারবে না।
গ) জলজ আগাছা দমনঃ পুকুরে ভাসমান , ডুবন্ত নানা জাতের আগাছা ও শেওলা তুলে ফেলতে হবে কারন ঃ
– মাছের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে
– মাটি ও পানির পুষ্টিকর উপাদান ব্যবহারের কারনে পুকুরে মাছের খাদ্য তৈরীতে বাধার সৃষ্টি হয়
– নার্সারি পুকুরে অতিরিক্ত তন্তÍ জাতীয় শেওলা থাকলে পোনা আহরনের সময় তন্তÍ জাতীয় শেওলায় আটকে পোনা মারা যায়
– কায়িক শ্রম দ্বারা এ আগাছা দূর করা যায়
– প্রতি শতাংশে ৮-১০ গ্রাম তুতে(কপার সালফেট)পানিতে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিলে ৩-৪ দিনের মধ্যে সমস্ত শেওলা মারা যায়।
জলজ আগাছ নিয়ন্ত্রনের উপকারিতাঃ
– পানিতে সরাসরি আলো পড়ে ফলে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়
– পোনা মাছের জন্য ক্ষতিকারক জীবানু ও প্রাণী ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে না
– পোনা মাছের চলাচল সহজ হয় এবং জাল টানতে সুবিধা হয়
– খাদ্য প্রয়োগে সুবিধা হয়
– পোনা উৎপাদন বেশী হয়।
ঘ) রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ দূরীকরনঃ রাক্ষুসে মাছ চাষকৃত মাছের রেণু / পোনা খেয়ে ফেলে, অচাষকৃত মাছ চাষকৃত মাছের রেণু / পোনার খাবার খেয়ে ফেলে তাই নার্সারি পুকুর হতে রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ যেমন-শোল,টাকি, গজার, বোয়াল,ফলি,চান্দা পুটি, মলা,চেলা,শিং মাগুর , কৈ সহ যে কোন ধরনের রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ দূর করতে হবে। মাছের রেনু পোনা ছাড়ার আগেই পুকুর শুকিয়ে ,বার বার জাল টেনে অথবা রোটেনন প্রয়োগ করে রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ পুকুর থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ দূরীকরনের উপকারিতাঃ
– রেণুর বাচার হার বেশী
– মাছের পোনা বাচার হার বাড়ে
– প্রাকৃতিক ও সম্পূরক খাদ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হয়
– মাছের রোগ বালাই হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ পুকুর থেকে দূরীকরনের উপায় –
পুকুর শুকিয়েঃ নার্সারি পুকুর হতে রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ দূরীকরণের সর্বোত্তম উপায় হলো শ্যালো মেশিন দিয়ে সেচে শুকিয়ে ফেলা। পুকুর শুকানোর পর তলায় প্রয়োজনে চাষ দেওয়া এবং কড়া রোদে বেশ কিছুদিন (১৫ দিন) পুকুর ফেলে রাখা। এ কাজ টি ফাল্গুন-চৈত্র মাসে করলে খরচ ও সময় দুইই কম লাগে।
বার বার জালটেনেঃ পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে ঘন ফাসের জাল বার বার টেনে রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ দূর করা যায়।
রোটেনন প্রয়োগ করেঃ রোটেনন পাউডার প্রয়োগ করে পুকুর হতে রাক্ষুসে ও অচাষকৃত মাছ দূর করা য়ায়। প্রতি শতাংশে প্রতি ফুট পানির গভীতার জন্য ৯.১ মাত্রার ২৫-৩০ গ্রাম রোটেনন প্রয়োজন। কড়া রোদে সকাল ১০-১১ টার সময় প্রয়োগ করলে রোটেননের কার্যকারিতা বেশি পাওয়া যায়। প্রয়োজনীয় মোট রোটেননের তিন ভাগের এক ভাগ কাই তৈরী করে ছোট ছোট বল করে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে এবং বল ছিটানোর পর পরই বাকি দুই ভাগ বেশে পরিমান পানির সাথে ভালবাবে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। প্রায় ২০-৩০ মিনিট পর মাছ আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে জাল টেনে সমন্ত মাছ ধরে ফেলেতে হবে। জাল টেনে পুকুরের পানি উলোট-পালট করে দিলে বিষের কার্যকারিতা বেড়ে যায়। রোটেনননের বিষাক্ততার মেয়াদ ৬-৭ দিন। এই রোটেনন পাউডার দিয়ে মারা মাছ খেলে কোন অসুবিধা হয় না।
রোটেনন প্রয়োগের সতর্কতাঃ
– রোটেনন গুলানো ও প্রয়োগের সময় হাতে পলিথিন ও নাকে মুখে গামছা বেধে নিতে হবে।
– রোটেনন বাতাসের অনুকুলে ছিটাতে হবে।
– রোটেনন প্রয়োগের পর হাত ভাল ভাবে সাবান দিয়ে নিতে হবে এবং পাত্র গুলো ও ভাল ভাবে পরিস্কার বরতে হবে।
– রোটেনন সব সময় বাচ্চাদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
– রোটেনন বৃষ্টির দিনে কিংবা মেঘলা সময়ে প্রয়োগ করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যাবে না।
– রোটেনন ব্যবহারের পর পাত্রটি ভাল ভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
ঙ) পুকুর প্রস্তÍতকালীন চুন প্রয়োগঃ পুকুরের তলদেশের মাটি সূর্যালোকে শুকিয়ে গেলে পুকুরের তরদেশে লাঙ্গল দিয়ে ভাল ভাবে চাষ করে শতাংশ প্রতি ১ কেজি হারে পোড়াচুন পাড় সহ সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
এ প্রক্রিয়ায় পুকুরের তলদেশের পরজীবি প্রাণী মারা যায় এবং পুকুরের পানি কিছুটা খারযুক্ত হয়। এছাড়াও মাটি থেকে পুষ্টিকর পদার্থ মুক্ত হয়ে পোনা মাছের খাবার উৎপাদনে সহায়তা করে। সন্ধা রাতে মাটির চাড়ি বা ড্রামে তিন গুন পানিতে চুন ভিজিয়ে রাখতে হবে। ঠান্ডা হওয়ার পর আরো ও পানি মিশিয়ে পানি ভর্তি পুকুরের ক্ষেত্রে ঢাল সহ সমস্ত পুকুরে সমান ভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। পুকুরে চুন প্রয়োগের ৩ দিন পরে পানি সরবরাহ করতে হবে। যদি পানি নিষ্কাশন না করে রোটেনন প্রয়োগ করা হয় তাহলে রোটেনন প্রয়োগের ৩-৫ দিন পর চুন দিতে হবে।
চুন ব্যবহারের মাত্রাঃ PH ৩-৫ চুন ৬ কেজি, PH ৫-৬ চুন ৪ কেজি, PH ৬-৭ চুন ২ কেজি।
প্রতি তিন মাস পরপর চুন প্রয়োগ করলে পুকুরের স্বাস্থ্য কর অবস্থা বজায় থাকে। এক্ষেত্রে চুনের মাত্রা হবে প্রাথমিক মাত্রার ১/৪ ভাগ থেকে ১/২ ভাগ।
ভাল চুন শনাক্তবরনের উপায়ঃ একটি কাচের গ্লাসে কিছু পরিমান পানি নিয়ে তাতে এক টুকরা চুন দিয়ে পরীক্ষা করা যায়। ভাল চুন বিক্রিয়া করে পানিতে বুদবুদ ও তাপ সৃষ্টি করে চুন কেনার সময় বাজারে বসে চায়ের কাপে বা গ্লাসে চুন ও পানি নিয়ে ভাল চুন সনাক্ত করা যায়।
চ) পানি প্রবেশঃ পুকুর শুকানো হলে চুন প্রয়োগের ২-৩ দিন পর পুকুরে পানি প্রবেশ করাতে হবে। পানি উত্তোলোনের ক্ষেত্রে গভীর নলকুপের বা শ্যালো ইঞ্জিনের দ্বারা মাটির নীচের পানি প্রবেশ করানো ভাল। যদি পুকুর বা অন্য ডোবা থেকে পানি প্রবেশ করানো হয় সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ফিল্টার নেট দিয়ে পানি ছেঁকে প্রবেশ করাতে হবে যেন পুকুরে কোন রাক্ষুষে ও অচাষকৃত মাছ ঢুকতে না পারে।
ছ) পুকুর প্রস্তÍত কালীন সার প্রয়োগঃ পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মানোর জন্য জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। সার প্রয়োগের ফলে পুকুরে অতি ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী জাতীয় জীব কনা জন্ম নেয় যা খেয়ে রেণু জীবন ধারন করে। এসব উদ্ভিদ ও প্রাণী জাতীয় জীবকণাগুলোকে বলা হয় প্ল্যাংক্টন। শুকনো পুকুরে প্রয়োজনীয় জৈব সার সমস্ত পুকুরে ছিটানোর পর চাষ দিয়ে তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। সার হিসাবে খৈলও ব্যবহার করা যেতে পারে। শতাংশ প্রতি আধা কেজি (০.৫০কেজি) খৈল রটিফার(প্রাণীকণা ) উৎপাদনে সহায়ক। অজৈব সার পুকুরে পানি ভরাটের পর একত্রে গুলে পানিতে ছিটিয়ে দিতে হবে।
পুকুর প্রস্তÍত কালীন চুন প্রয়োগের ১-২ দিন পর এবং রেণুপোনা মজুদের কমপক্ষে ৪-৫ দিন আগে সার প্রয়োগ করতে হবে। সূর্যোলোকিত সকাল ৯-১০ টার সময় সার প্রয়োগ করা ভাল। এতে পানিতে পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত হয়। মাছের বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক খাদ্য নিশ্চিত করে।
সার প্রয়োগের মাত্রা ও প্রযোগ পদ্ধতিঃ
সারের নাম | সারের ধরন | প্রয়োগ মাত্রা (প্রতি শতাংশে) | প্রয়োগ পদ্ধতি |
জৈব সার | গোবর বা কম্পোষ্ট | ৬-১০ কেজি | শুকনো পুকুরঃ প্রয়োজনীয় পরিমান জৈব সার সমান ভাবে পুকুরের তলায় ছিটিয়ে দেয়ার পর চাষ দিয়ে ভাল ভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে |
অজৈব সার | ইউরিয়া
টিএসপি এমওপি |
৭৫-১০০ গ্রাম
১০০-১৫০ গ্রাম ২৫-৫০ গ্রাম |
পানি ভর্তি পুকুরঃ পরিমান মতো গোরব পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। পানিতে টিএসপি রাতে ভিজিয়ে পরের দিন সূর্যোলোকিত সকালে (৯ -১০ টা) ইউরিয়ার সাথে মিশিয়ে পুকুরের অগভীর অংশে ভালভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। |
দ্রুত প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য খৈল ৩০০-৪০০ গ্রাম/শতাংশ এবং ইউরিয়া ৮০-১০০ গ্রাম/শতাংশে প্রয়োগ করতে হবে। (খৈল ও ইউরিয়া একটি পাত্রে তিন গুন পানির সাথে ১২-২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে সূর্যের আলোতে সকাল১০-১১ টায় সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
জ) প্রাকৃতিক খাদ্য ও প্রাকৃতিক খাদ্য পরীক্ষাঃ রেণু মজুদের পূর্বেই পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরী হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করতে হবে। রেণুর পুকুরের পানির রং থাকবে লালচে সবুজ বা বাদামী সবুজ। পুকুরে সার দেয়ার ৩-৪ দিনের মধ্যেই মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরী হয়। সার দেয়ার ৪-৫ দিন পর পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উপস্থিতি পরীক্ষা করতে হবে। কারন পোনা মাছের বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান প্রাকৃতিক খাদ্যে আসে।
প্রাকৃতিক খাদ্যঃ সার দিলে পুকুরে উদ্ভিদ ও প্রাণী কণা জন্ম নেয়। পানির বর্ণ দেখে বোঝা যায়। যেমন প্রাকৃতিক খাদ্যযুক্ত পানির বর্ন হালকা সবুজ, বাদামি সবুজ, বা হালকা বাদামি বর্ণের হয়ে থাকে।
প্রাকৃতিক খাদ্য ২ ধরনেরঃ ক) উদ্ভিদ কণা খ) প্রাণী কণা
ঝ) পানির বিষাক্ততা পরীক্ষাঃ পানিতে বিষক্রিয়া থাকলে রেণু মারা যাবে। তাই পুকুরে রেণু ছাড়ার ১-২ দিন আগে বিষ দেওয়া পুকুরের পানিতে একটি হাপা টাঙ্গিয়ে বা পাতিলে ১০-১৫ টি পোনা ছেড়ে ৭-৮ ঘন্টা পর্যন্ত দেখতে হবে পোনাগুলো মারা য়ায় কি না? যদি পোনা মারা না যায় তবে বুঝতে হবে যে, পুকুরের পানিতে বিষাক্ততা নেই। পোনা মারা গেলে বুঝতে হবে যে পানি বিষাক্ত। এ অবস্থায় আরো কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে।
ঞ) ক্ষতিকর জলজ কীটপতঙ্গ দমন: নার্সারি পুকুরে সার প্রয়োগের ৩-৪ দিনের মধ্যেই পানির বর্ণ সবুজ হবে এবং প্লাংক্টন সহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকা মাকড় যেমন- হাঁসপোকা,ব্যাঙাচী বড় প্রানীকনা (মাখন পোকা) ইত্যাদি জন্মায়। ক্ষতিকর পোঁকা মাকড় মাছের রেণুপোনা খেয়ে ফেলে অথবা পেট কেটে মেরে ফেলে। খাদ্যের জন্য রেণুর সাথে প্রাতিযোগিতা করে। ফলে রেণুর মড়ক বেশী হয়। রেণু ছাড়ার আগে ও পরে এদের নিয়ন্ত্রন করা আবশ্যক।
রেণু পোনা মজুদ কালীন ব্যবস্থাপনাঃ
প্রজাতি নির্বচনঃ নার্সারি পুকুরে এক প্রজাতির রেণু ব্যবহার করা উত্তম। নার্সারি কার্যক্রমে ভাল মানের পোনা উৎপাদন এবং মুনাফা অর্জনকে সামনে রেখে প্রজাতি নির্বচনের ক্ষেত্রে অনেক গুলো বিষয় বিবেচনা করতে হবে। যেমন নির্বাচিত প্রজাতির রেণু এলাকা গত প্রাপ্যতা, চারা পোনার এলাকাগত চাহিদা পুকুরের ধরন ও আকার , চাষের ধরন, চাষির অভিজ্ঞতা , চাষির আর্থিক সংগতি ইত্যাদি।
উল্লেখিত বিষয় সমূহ বিবেচরা করে আমাদের দেশে সাধারনত রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্রাসকার্প, মিরর কার্প,বিগহেড কার্প, রাজ পুটি/থাই পুটি, কমন কার্প, পাঙ্গাস, থাইকৈ, ভিয়েতনামী কৈ,শিং, মাগুর ও মনোসেক্্র তেলাপিয়ার পোনা নার্সারিতে চাষ করা হয়ে থাকে।
পোনার পরিচয়ঃ
ডিম পোনাঃ ডিম ফোটার পর ২-৩ দিন পর্যন্ত অবস্থা। পেটে একটি থলি থাকে। বাইরের খাবার খায় না।
রেণু পোনাঃ পেটের থলি শেষ হওয়ার পরের অবস্থা। দেখতে মশার বাচ্চার মত। সিদ্ধ ডিমের কুসুম,ভাসমান ছোট কীট, ময়দা , খৈল ও মিহি কুড়া খেতে পারে।
ধাণী পোনাঃ আঙ্গুলের এক করের মত অবস্থা। ভাসমান ছোট কীট, শেওলা কণা এবং খৈল কুড়া খেতে পারে। রেণু থেকে ধাণী হতে ৮-১০ দিন সময় লাগে।
চারা পোনাঃ আঙ্গুলের মত বা আরো বড়(৭-১৫ সেমি) অবস্থা। চারা পোনা হতে ৪০-৬০ দিন সময় লাগে। চাষের জন্য চারা পোনাই মজুদ করা হয়।
প্রজাতি অনুযায়ী প্রতি গ্রামে রেণুর সংখ্যা নি¤œরূপঃ
ক্রমিক নং | প্রজাতি | রেণুর গড় সংখ্যা/গ্রাম |
০১ | কাতলা | ৪০০ টি |
০২ | রুই | ৪৭৫ টি |
০৩ | মৃগেল | ৪০০ টি |
০৪ | সিলাভার কার্প | ৩২৫ টি – ৪০০ টি |
০৫ | গ্রাস কার্প | ৪৫০ টি |
০৬ | মিরর কার্প | ৪৫০ টি |
০৭ | বিগহেড | ৩০০ টি |
০৮ | সরপুঁটি/রাজ পুঁটি | ৭০০-৮০০ টি |
রেণু পোনা মজুদ ঘনত্বঃ এ পদ্ধতিতে প্রস্তÍতকৃত নার্সারি পুকুরে ৩-৫ দিন বয়সের রেণু পোনা প্রতি শতাংশে ৪০-৫০ গ্রাম করে মজুদ করা যায়। প্রথমে অপেক্ষাকৃত ছোট পুকুরে রেণু ছেড়ে ১০-১৫ দিন পর ধানী পোনা লালন পুকুরে কাটাই করতে হবে।
নার্সারি পুকুরে এক সাথে এক প্রজাতীর রেণু মজুদ করা ভাল। একের অধিক প্রজাতির রেণু এক সাথে মজুদ করলে ভাল ফল পাওয়া যায় না।
রেণুপোনা অভ্যস্তকরণ ও পুকুরে মজুদঃ পুকুরে ছাড়ার আগে রেণু পোনাকে নুতন পরিবেশের সাথে সহনশীল করে নিলে মৃত্যু হার অনেকাংশে রোধ করা যায়। এজন্য
– প্রথমে রেণু পরিবহনকৃত ব্যাগ বা পাত্রটি পুকুরের পানিতে ১৫-২০ মিনিট ভাসিয়ে রাখতে হবে।
– তারপর মুখ খুলে হাত দ্বারা পরিবহন ব্যাগের বা পাত্রের পানি আস্তে আস্তে অদল-বদল করতে হবে
– পুকুর এবং ব্যাগের পানির তাপমাত্রা সমতা আসলে ব্যাগটি কাত করে ধরে আলতোভাবে ঢেউ দিয়ে মৃদু স্রোতের ব্যবস্থা করলে সুস্থ সবল রেণু স্রোতের বিপরীতে ব্যাগ থেকে ধীরে ধীরে পুকুরে চলে যাবে। এ কাজটি ২৫-৩০ মিনিট সময় ধরে করতে হবে।
নার্সারি পুকুরের গুরুত্ব: সুস্থ্য সবল পোনা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন ভাল মানের নার্সারি। রেণু পোনা খুবই সংবেদনশীল। তাই নার্সারি পুকুর যদি সঠিক ভাবে প্রস্তÍত করা না হয় তাহলে কাংখিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব না। আমাদের দেশে বাড়ীর আশে-পাশে ছোট এবং মাঝারী আকারের অসংখ্য পুকুর রয়েছে।
এসব পুকুর গুলো যদি চাষের আওতায় নিয়ে চাষ করা হয় তাহলে বিভিন্ন এলাকায় ভাল মানের পোনার চাহিদা পূরন করা সম্ভব। এর ফলে গ্রামীন বেকার সমস্যার আংশিক সমাধান,চাষিদের আয় বাড়ানো, মজুদ পুকুরে ভাল মানের পোনার চাহিদা পূরন, মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি, পারিবারিক শ্রম সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।আমাদের দেশের ছোট- মাঝারী পুকুর গুলো রেণু পোনা চাষের আওতায় আনলে মৎস্য উৎপাদনের পাশাপাশি বিকল্প কর্ম সংস্থান সৃষ্টি হবে।
– মো. মোস্তাফিজুর রহমান
প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞ, অ্যাকুয়াকালচার এনআইএ প্রকল্প, ওয়ার্ল্ডফিশ-বাংলাদেশ।
+88 01718-714646