কবি মোহাম্মদ রফিক একাধারে একজন কবি, লেখক ও শিক্ষক । ১৯৬০-এর দশকে একজন মননশীল আধুনিক কবি হিসাবে তার আত্মপ্রকাশ। পাকিস্তান আমলে (ষাটের দশকে) ছাত্র আন্দোলন ও কবিতায়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে কাব্যিক রসদ যুগিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।।
বাংলার জল-মাটি ও সাধারণ মানুষের মুক্তি চেতনার কবি কবি মোহাম্মদ রফিকের জন্ম ১৯৪৩ সালে ২৩ অক্টোবর বাগেরহাট জেলার বেমরতা ইউনিয়নের বৈটপুর (বর্তমান চিতলী) গ্রামে। তার পিতা সামছুদ্দীন আহমদ এবং মাতা রেশাতুন নাহার। আট ভাই-বোনের মধ্যে তিনি জেষ্ঠ্য। কবির শৈশব কেটেছে বাগেরহাটেই।
স্থানীয় বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করলেও পরবর্তীতে পিরোজপুর জেলা স্কুল, বরিশাল ও খুলনা জেলা স্কুলে পড়াশুনা করেন।
খুলনা জেলা স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (মাধ্যমিক) পাস করেন মোহাম্মদ রফিক। মেট্রিক পাশ করে ঢাকার নটরডেম কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন, কিন্তু পরে ঢাকা কলেজে মানবিক বিভাগে চলে যান। এ সময় কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাথে তার বন্ধুত্ব হয় যা তাঁর সাহিত্যিক চেতনায় প্রগাঢ় ছাপ ফেলে।
১৯৬১ সালে ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চ মাধ্যমিক) পাস করেন। সে বছরই রাজশাহী সরকারী কলেজে ইরেজিতে অনার্সসহ স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন কবি মোহাম্মদ রফিক।
এরপর অংশ নেন সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে। সামরিক আইনে তাকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয় সামরিক আদালত। এসময় দিনের পর দিন পালিয়ে বেরান তিনি। একসময় জেলে যান। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে থাকার কারনে তাকে বহিস্কৃত করা হয় রাজশাহী কলেজ থেকে।
পরে, সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে মামলায় জয়লাভ করে পাস কোর্সে বি.এ পাশ করেন ১৯৬৫ সালে। একই বছর ইংরেজী বিষয়ে এম.এ. তে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৫৮-৫৯ সালে কবি মোহাম্মদ রফিক যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে, আইয়ুবি আমলে খুলনা, যশোর, বাগেরহাট এবং পরবর্তীতে বগুড়া এবং রাজশাহী অঞ্চলে ছাত্র ইউনিয়নকে সংগঠিত করেন।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখী পূর্ণিমায়’। প্রকাশ কালা ১৯৭০ সাল।
১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন ১নং সেক্টরের হয়ে। অংশ ন্যান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।
১৯৭৬ সালে প্রকাশ পায় তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধুলোর সংসারে এই মাটি’।
১৯৮০-্এর দশকের শুরুতে স্বৈরাচারী শাসকের আবির্ভাবে দেশে সাম্প্রদায়িকতা, দারিদ্র ও একনায়কতন্ত্রের যে ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয় তারই প্রেক্ষাপটে লেখেন ‘খোলা কবিতা’ (১৯৮৩)। সামরিক শাসন ও শাসকের তথাকথিত কবি হওয়ার অভিলাষের বিরুদ্ধে তাঁর রচিত ‘সব শালা কবি হবে’ — কবিতাটি সে সময় আকাশ ছোয়া জনপ্রিয়তা পায়।
কাব্যগ্রন্থ–
· ‘বৈশাখী পূর্ণিমায়’ (১৯৭০), · ‘ধুলোর সংসারে এই মাটি’ (১৯৭৬), · ‘কীর্তিনাশা’ (১৯৭৯), · ‘খোলা কবিতা’ ও ‘কপিলা’ (১৯৮৩), · ‘গাওদিয়ায়’ (১৯৮৬), · ‘স্বদেশী নি:শ্বাস তুমিময়’ (১৯৮৮), · ‘মেঘে এবং কাদায়’ (১৯৯১), · ‘রূপকথা কিংবদন্তি’ (১৯৯৮), · ‘মৎস্যগন্ধা’ (১৯৯৯), · ‘মাতি কিসকু’ (২০০০), · ‘বিষখালি সন্ধ্যা’ (২০০৩), · ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০০৩), · ‘কালাপানি’ (২০০৬), · ‘নির্বাচিত কবিতা’ (২০০৭), · ‘নোনাঝাউ’ (২০০৮), · ‘দোমাটির মুখ’ (২০০৯), · ‘ত্রয়ী’ (২০০৯), · ‘মোহাম্মদ রফিক রচনাবলী -১’ (২০০৯-ঐতিহ্য), · ‘মোহাম্মদ রফিক রচনাবলী -২’ (২০১০-ঐতিহ্য)।
১৯৯৩ সালে অরুণ সেনের সম্পাদনায় প্রতিক্ষণ থেকে প্রকাশিত হয় মোহাম্মদ রফিকের নির্বাচিত কবিতা গ্রন্থ। কবিতার পাশাপাশি তার রয়েছে বেশ কয়েকটি গদ্যগ্রন্থ। এর মধ্য ‘ভালোবাসার জীবনানন্দ’ (২০০৩), ‘আত্মরক্ষার প্রতিবেদন’ (২০০১) ও ‘স্মৃতি বিস্মৃতির অন্তরাল’ (২০০২) অন্যতম।
কবি মোহাম্মদ রফিক আয়ওয়াতে ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন ১৯৯৩ সালে। মার্কিনিদের আয়ওয়া শহরের অভিজ্ঞতা, ভিন দেশের লেখকদের সঙ্গে কবির মতবিনিময়, দেশ-বিদেশের সাহিত্যের খবর ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয় তার “দূরের দেশ নয় আয়ওয়া” বইটি। নব্বইয়ের দশকে বেশ কিছু ছোটগল্প লেখেন তিনি।
পুরষ্কার-
১৯৮১ সালে তিনি আলাওল পুরষ্কার, ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমী পুরষ্কার, ২০১০ সালে একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কবি।
চাকরী জীবন–
কবি মোহাম্মদ রফিক শিক্ষাকতা করেছেন বাজিতপুর কলেজ, চট্টগ্রাম মহিলা কলেজ এবং স্বাধীনতার পরে ঢাকা কলেজে। ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে যোগ দেনন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। ২৯ জুন ২০০৯ পর্যন্ত দীর্ঘকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পর চাকরী জীবনের অবসরে যান তিনি।
ব্যক্তি জীবন-
ব্যক্তি জীবনে তার সহধর্মিনী ছিলেন জিনাত আরা রফিক। যিনি ২০০৫ সালের ৭ ডিসেম্বর মারা যান। দুই ছেলে শুভস্বত্ব রফিক ও শুদ্ধস্বত্ব রফিক। অবসর জীবনে কবি তার উত্তরার নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন।
ব্লগ মডারেটর, বাগেরহাট ইনফো ডটকম।