প্রচ্ছদ / লেখালেখি / ফিচার / আমার চোখে আনোয়ার হোসেন

আমার চোখে আনোয়ার হোসেন

• সুব্রত কুমার মুখার্জী

Anower-sir১৯৮৯ সাল আমি লেখাপড়া ছেড়ে গরু রাখি, মাছ ধরি, সুপারিগাছ থেকে সুপারি পাড়ি। এরকম সময় আমার ছোট চাচা একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন সেখানে ভর্তির জন্য নিয়ে গেলেন।

ভর্তি পরীক্ষা দিলাম নবম শ্রেণীতে কিন্তু আমার লেখাপড়া দেখে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মনে করলেন আমি নবম শ্রেণীর উপযুক্ত নই অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। প্রথম ক্লাস, সকালে লাইন বেধে দাড়িয়ে গেলাম। আমি পিটি শিক্ষকের নিয়ম মোতাবেক সোজা হয়ে দাড়াতে পারি না, ১ নং বা ২ নং ব্যায়মও পারি না।

আমার স্কুলে এগুলো ছিল না। আমরা ক্লাসের সদর দরজা থেকে মুলি বাশের বেড়ার ফাক দিয়ে ঢুকতে বেশী পছন্দ করতাম। রোদে দাড়াতে দাড়াতে একসময় একজন শিক্ষক যিনি এসে সবাইকে আপনি সম্বোধন করে ঐ দিনের কথা বলতে লাগলেন। এই শিক্ষককে আমি আগেও দেখেছি আমার বাবার মামার (জীবানন্দ চক্রবর্ত্তী) ছাত্র ছিলেন। আমার দাদুর কাছে তিনি যেতেন কিন্তু তাদের কাছে তো আমরা যেতাম না।

আমাদের ক্লাসে ৭ জন ছাত্র ছিল যার মধ্যে শেষের থেকে দ্বিতীয় অবস্থান ছিল আমার। কি জানি শিক্ষকরা হয়ত আমার সেই দাদুর কথা ভেবেই আমাকে প্রত্যেকদিন সকালে গণিত শেখার জন্য যেতে হত ফনি ভূষন সাহার কাছে। যিনি একজন সন্ন্যাসী সূলভ ব্যক্তি ছিলেন। আমি বাইরে লোকজনের সাথে কথা বলতে ভয় পেতাম কিন্তু আস্তে আস্তে এই আনোয়ার স্যার, ফনি স্যার, জব্বার স্যার, যুথি আপাদের প্রচেষ্টায় বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সেরা ছাত্র হই একসময় বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের সমন্বয়কের কাজ করি।

 আজ আমি একটি প্র্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভূমিকা পালন করছি। আমাকে প্রস্তুতি অপ্রস্তুতিতে প্রায়দিনই ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক সূধী জনদের সভা করতে হয়। এখানে আমি এখন ভাল বক্তা না হলেও আমার কথা সবাই শোনে কিন্তু এর একটি ইতিহাস বলতে হয়। তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র উপস্থিত বক্তৃতা হচ্ছে পরিচালনা করছেন শাহ আলমগীর বাদশা ভাই। আমার আগে বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ বক্তা আকন মোহাম্মদ রায়হান বক্তব্য রাখল একটি ঝড়ের রাত।

দূর্ভাগ্যবশত: এরপর আমার পালা আমার কাগজে লেখা শীতের সকাল। সকলের সামনে দাড়িয়ে আমার পা কাপছে, হাত কাপছে বুক শুকিয়ে যাচ্ছি সামনে বসা আনোয়ার স্যার একসময় আমার কাছে উঠে এলেন আমাকে কতগুলি প্রশ্নকরতে থাকলেন শীতে আমাদের বাড়িতে কি কি পিঠা হয়? শীতে কিভাবে ষঠি দিয়ে পালো হয়? শীতে আমাদের বাড়িতে কয়খান খেজুরের রস হয়? প্রথম প্রশ্নগুলির উত্তর ছোট হলেও একসময় বড় হতে লাগল। বুঝতে পারলাম সব উত্তর গুলি এককরলে শীতের সকাল হয়ে যায়।

বিদ্যালয়ের গন্ডি পার হয়ে পাশের বাগেরহাট বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। একটি বিজ্ঞান সংগঠন করতে উৎসাহি হয়ে কয়েকজন (কামরুল বর্তমানে সাংবাদিক, সবুজ বর্তমানে ডিসি অফিসে কর্মরত) স্যারের সাথে দেখা করলাম। স্যার বল্লেন তোমরা শহীদ হাদিসের নামে নামকরণ কর। আমরা শহীদ হাদিসের সম্পর্কে জানিনা স্যারের সাথে একমত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। স্যার অনেক তথ্যর পাশাপাশি বলেলন তোমরা তার বড় ভাইয়ের সাথে গিয়ে দেখা কর। শহীদ হাদিস সম্পর্কে জানলাম এভাবেই কখন যে স্যারের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বাগেরহাট নিয়ে একটি আগ্রহ তৈরী হয়ে গেল।

একসময় বাগেরহাট ছেড়ে চলে গেলাম আবার যখন ফিরে এলাম তখন আদর্শ বিদ্যালয়ের থেকে অবসরে গেছেন আনোয়ার স্যার।

বিভিন্ন কাজ নিয়ে স্যারের কাছে যেতাম সামছু কবির জীবন ও কর্ম, বাগেরহাটের বিভিন্ন বিষয়ে স্যারের কাছে গেলে সবচাইতে সহজে কাজটি হয়ে যেত। কথার ছলে স্যারকে বলতাম স্যার বাগেরহাটের একটি ইতিহাস আপনি লেখেন। স্যার হেসে উত্তর দিতেন লেখার কাজ তোমাদের আমি পথ দেখাব।

তাইই সত্য স্যার নিজে লেখেন না স্যার জ্ঞান দিয়ে অন্যে লেখে। স্যার মঞ্চ তৈরী করেন অন্যরা গান গায়। বাগেরহাট ইতিহাস-ঐতিহ্য এমনভাবে তার সাথে সম্পর্কযুক্ত বাগেরহাট শহরের শালতলায় একটি দোকান দিলেন বলা চলে বসার জায়গা করলেন নাম দিলেন খলিফাতাবাদ। নিজের গ্রামে একটি প্রতিষ্ঠান করলেন সেখানে ডাক্তার নিয়ে স্বাস্থ্য ক্যাম্প করতেন এখানে উল্লেখ্য স্যারের প্রচেষ্টায় বাগেরহাটে যখন চক্ষু শিবির করতেন আমরা বিদ্যালয়ের ছাত্ররা সেই রোগীদের অপারেশনের পরের দিন খাবার খাওয়াতাম।

বাগেরহাট জেলা পরিদর্শনে আসলেন বিট্রিশ রাজকবি। বিদ্যালয় থেকে আমাদের ষাটগুম্বজে নিয়ে যাওয়া হলো সেদিন বুঝতে পারিনি স্যারের সাথে কথা বলতে বলতে আমাদের মাঝখান থেকে গিয়েছিলেন সেই কবি। বুঝতে পারি অনেক পরে। আদর্শ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য শিক্ষা ভ্রমণ করা হতো নিউজপ্রিন্ট মিল বা শিপইয়ার্ডে, কোন পিকনিক কর্ণারে নয়।

অনেক অনেকদিন চলে গেল তথ্য অফিসের একটি প্রচারনায় স্যারের সাথে দেখা হয়। তিনি বলেন, ‌‌‍”তোমার সাথে কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা আছে আমি একদিন তোমার অফিসে আসব।”

স্যার আসলেন না। বরং বাগেরহাট পিসি কলেজের একজন শিক্ষক ফোন করে জানালেন আনোয়ার স্যার নেই। শোনামাত্র বাড়িতে গেলাম।

গিয়ে দেখি স্যার শায়িত অনেক লোক হাজির কিন্তু কি একটা সমস্যা। সমস্যাটা বুঝতে চাইলাম না স্যার যেমন সবাইকে মঞ্চ করে দিয়েছেন আবার অনেকেই সেই মঞ্চের নায়কের অভিনয় করতে করতে ভূলে গেছে পরিচালক কত কষ্ট করে তাকে সাজিয়েছেন।

আজ হয়ত অনেকেই ভাল অভিনয় করে কিন্তু ভুলে গেছে সেই স্রষ্টাকে কিন্তু আমরা আসলে কি ভুলতে পেরেছি !

About Subrata Mukerjee

উন্নয়ন কর্মী