রুদ্র : তোমাকে বড় আজ বেশি প্রয়োজন
সুমেল সারাফাত
আমরা যখন চরম অস্থির একটা সময় পার করছি, আপোসকামিতা আমাদের আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে, স্বার্থপরতা আমাদের আমানুষে পরিণত করছে তখন তোমার কথা বড় বেশি মনে পড়ে।
ভীষণ চাই, তুমি ফিরে আসো সেই না-ফেরার দেশ থেকে। আমাদের চেতনায় আঘাত করো, আমাদের নির্লিপ্ততা তছনছ করো, আমাদের আপোসকামী স্বার্থপরতায় তীব্র ধিক্কার দাও। চারপাশে যখন ‘কোনো কথা নেই- কেউ বলে না, কোনো কথা নেই কেউ চলে না,/ কোনো কথা নেই- কেউ টলে না, কোনো কথা নেই- কেউ জ্বলে না/ যেন অন্ধ, চোখ বন্ধ, যেন খঞ্জ, হাত বান্ধা,/ ভালোবাসাহীন, বুক ঘৃনাহীন, ভয়াবহ ঋন/ ঘাড়ে চাপানো- শুধু হাঁপানো, শুধু ফাঁপানো কথা কপচায়’; তখন তুমি আমাদের কণ্ঠে তুলে দাও সংগ্রামের অমোঘ মন্ত্র : ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই’।
১৯৯১ সালের ২১ জুন চমৎকার এক ভোরে তুমি আমাদের সবাইকে রেখে চলে গিয়েছিলে না-ফেরার দেশে। তোমার পরম স্নেহময়ী মা, তোমার বোন তোমার মুখ সাদা কাপড় দিয়ে কিছুতেই ঢাকতে দিচ্ছিল না। কারণ তুমি তো মরতে পারো না। তুমি ঘুমাতে পারো, কিন্তু মৃত্যু যে তোমাকে মানায় না। এত প্রাণ, এত উদ্দামতা, এত গতিময়তা, এত দ্রোহ নিয়ে তুমি কিভাবে ঘুমিয়ে থাকবে? মাত্র ৩৪ বছর কি চলে যাওয়ার সময়?
সমাজের সকল বৈষম্য, শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা আর সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আমৃত্যু তোমার কলম চলেছে। যখন কলম রেখে সশরীরে উপস্থিতির প্রয়োজন, তখন তুমি বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে হাজির হয়েছ প্রতিবাদের মঞ্চে। অন্য অনেকের সঙ্গে তোমার পার্থক্য এখানেই। নিজস্ব দর্শন আর বিশ্বাসকে শুধুমাত্র লেখার মধ্যে বন্দী না রেখে নিজের জীবন-যাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ ঘটিয়েছ।
অন্যায়ের সঙ্গে আপোস তোমার ধাতে ছিল না। সেই তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে তা শুরু। তোমার নানার নামে স্কুলটিতে তোমার বাবা ছিলেন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আবৃত্তিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলে তুমি। কিন্তু বাবা তোমার পুরস্কার দ্বিতীয় স্থান অধিকারীকে আর তোমাকে দ্বিতীয় স্থানের পুরস্কার দিলে, তুমি পুরস্কার গ্রহণ না করে বাড়ী এসে মাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলে বাবা তোমার প্রতি অবিচার করেছে। তোমার যোগ্যতা দিয়ে তুমি প্রথম হয়েছ। বাবার সভাপতিত্বের জোরে না। পরে বাবা ভুল বুঝতে পেরে তোমাকে প্রথম পুরস্কারের মতো অনুরূপ আর একটি পুরস্কার এনে দিয়েছিল। কিন্তু তুমি আর সেই পুরস্কার গ্রহণ করোনি। সেই শুরু। তারপর জীবনের ধাপে ধাপে তুমি এগিয়েছ কোন আপোস না-করে।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় তুমি মাত্র তের বছরের কিশোর। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কর্মসূচিতে তুমি নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করেছ। হরতাল, মিছিল আর মিটিংয়ে তুমি সামনের কাতারে। মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হল তখন তুমি নবম শ্রেণীর ছাত্র। যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্যে তুমি অস্থির হয়ে আছো। ঠিক সেই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তার অপরাধে তোমার চিকিৎসক বাবাকে পাকিস্তানি নৌবাহিনী তুলে নিয়ে নির্মম অত্যাচার করে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখল। তারপরও তুমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে মায়ের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয় করলে। কিন্তু এইরকম পরিস্থতিতে স্নেহময়ী মা তার প্রথম সন্তানকে কিছুতেই যুদ্ধে যেতে দিলেন না।
বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া, যুদ্ধে যেতে না-পারার বেদনা, সেই সাথে চারপাশের নৃশংস ধ্বংসযজ্ঞ, দেশব্যাপী পৈশাচিক হত্যা-নির্যাতন তোমার ভাবনা-জগৎকে তুমুলভাবে আন্দোলিত করে। বাবার ইচ্ছা ছিল তুমি চিকিৎসক হবে। তোমারও বাবার স্বপ্নপূরণের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীন বাংলাদেশ তোমার স্বপ্নের পটভূমি বদলে দিল। তুমি হাতে তুলে নিলে স্বপ্নবান অস্ত্র- ‘কবিতা’, নিজেকে চিনালে ‘শব্দ-শ্রমিক’ হিসেবে।
সমাজে বিদ্যমান অসাম্য, শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তোমার শিল্পিত উচ্চারণ দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তুমি সাধারণ পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিলে। সিরাজ শিকদার, বঙ্গবন্ধু, কর্নেল তাহের, চারনেতাসহ সকল নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে তোমার কলম গর্জে উঠল। তুমি লিখলে- ‘থামাও, থামাও এই মর্মঘাতী করুন বিনাশ, এই ঘোর অপচয় রোধ করো হত্যার প্লাবন’। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের পর স্বাধীনতা-বিরোধীদের উত্থানে তুমি লিখলে সেই কালজয়ী উক্তি – ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’।
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আবার তোমার কলম গর্জে উঠল। সশস্ত্রবাহিনীকে উদ্দেশ্য করে তুমি লিখলে, ‘দাঁড়াও নিজেকে প্রশ্ন করো- কোন পক্ষে যাবে?/ একদিকে বিত্তবান, অন্যদিকে বিত্তহীন ক্ষুধার্ত সমাজ। ইতিহাস স্বাক্ষী দ্যাখো, অনিবার্য এ-লড়াই- কোন পক্ষে যাবে?’ কবিতার পাশাপাশি তুমি আবারও রাজপথে নেমে এলে। সমস্ত মিছিল, মিটিং, সংগ্রামে তুমি সামনের কাতারে। নূর হোসেনের হত্যার পর তুমি লিখলে, ‘হাজার মৃত্যু দিয়ে গড়া ঘরখানির ভিত, আজো তবু সব মানুষের রক্তে কেন শীত!/ বুলেট এবং বুটের মুখে খুঁজতে থাকে আপোষের আরাম।/ নূর হোসেনের রক্তে লেখা আন্দোলনের নাম’। ময়মনসিংহে কবিতা পাঠের আসর থেকে তোমাকে গ্রেপ্তারের জন্যে গোয়েন্দা পুলিশ পাঠানো হল। সেদিন সেই কবিতা পাঠের আসরে তোমার ভক্তরা ঘোষণা করল, সাহস থাকলে তাদের সামনে থেকে রুদ্রকে ধরে নিয়ে যাক। পুলিশ সে সাহস দেখাতে পারল না।
সমমনা কবি, শিল্পী, অভিনেতা, আবৃত্তিকার ও ছাত্রনেতাদের সাথে নিয়ে শুরু হল তোমার সংগ্রামী সাংস্কৃতিক জোট গড়ার উদ্যোগ। তোমরা সফল হলে। পরবর্তীকালে যা রূপান্তরিত হল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শুরু হল সর্বময়ী সংগ্রাম। এরপর স্বৈরাচার শাসকের এশীয় কবিতা উৎসবের বিরুদ্ধে কবিদের একত্রিত করে শুরু করলে জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের কাজ। ১৯৮৭ সালে তোমার লেখা গান হল প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসবের উদ্বোধনী সঙ্গীত। তুমি লিখলে, ‘শৃংখল মুক্তির জন্যে কবিতা আজ, ছিঁড়ে ফেলে লাবন্য লালিমা, হয়ে ওঠে সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার’।
তুমি অসীম সাহসী ছিলে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কোনো শক্তির ভয়ে কখনো তুমি পিছু হটো নি। ১৯৮৬ সালে গ্রীন রোডের একটি রেস্তোরায় কয়েকজন মুক্তিযুদ্ধবিরোধীর সঙ্গে তুমি একা লড়াই করেছিলে। তারা সেখানে একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর গুণগান করছিল। তুমি সেই টেবিলের সামনে গিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলে। তারা সংখ্যায় ৮/১০ জনের মতো ছিল। আর তুমি একা। দুদিন পর মাথায় দুইটা সেলাই নিয়ে তুমি বাসায় এসেছিলে। তারা মেরে তোমার মাথা রক্তাক্ত করেছিল।
কিন্তু তোমাকে দমাতে পারে নি। এরপর আরেকদিন পশ্চিম রাজাবাজারের রাস্তায় একটি ওয়াজ মাহফিলের প্রচারে আরো একজন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর নাম মাইকে প্রচার করতে থাকলে তুমি রাস্তায় নেমে সেই মাইক বন্ধ করে দিয়েছিলে। ১৯৮৭ সালে তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তুমি মংলায় গিয়ে ঠিকাদারি করেছিলে কিছুদিন। তোমার প্রথম কাজ ছিল মংলা উপজেলা পরিষদ ভবন নির্মাণ। সততার সঙ্গে কাজ করবার কারণে তুমি অনেক লোকসান করলে। এরপর বিল তুলতে গেলে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘুষ ছাড়া তোমার ফাইল সই করছিল না। কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর তুমি একদিন তার কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে তার কলার চেপে ধরে বলেছিলে, ‘আমার ফাইল স্বাক্ষর কর। রুদ্র কখনো কাউকে ঘুষ দেয় না’। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বাধ্য হয়েছিল ঘুষ না নিয়ে ফাইলে স্বাক্ষর করতে। সাহসিকতার এরকম কতো দৃষ্টান্ত যে তোমার জীবনে আছে!
জীবনে কোনো অন্যায়ের সঙ্গে তুমি আপোস করো নি। এর জন্যে খেসারতও তোমাকে কম দিতে হয় নি! আপোস করো নি বলে তসলিমার সঙ্গে তোমার সংসার ভেঙে গিয়েছে। আপোস করো নি বলে তোমার ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু শেষদিকে এসে তোমার শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। যে কবিতা পরিষদ গঠনে তোমার মেধা-মনন আর শ্রম উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলে সেই কবিতা পরিষদের ভিতরের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে তোমার একটুও বুক কাঁপে নি। ১৯৯০ সালে জাতীয় কবিতা উৎসবের আসরে কবিতা পড়তে মঞ্চে উঠে বলেছিলে, ‘দেশের ও কবিতা পরিষদের ভিতরের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আমি কবিতা পড়ছি’। এরকম প্রতিবাদ তোমাকেই মানায়, রুদ্র।
আজ আমরা ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু’ হয়ে আছি। ব্যক্তিগত স্বার্থ যেখানে বিপন্ন হতে পারে সেখানে অন্যায় দেখেও আমরা উটপাখির মতো মুখ ঘুরিয়ে রাখি। আমরা মেরুদ-হীন হয়ে পড়েছি। আমরা সারাক্ষণ ব্যস্ত আপোসে, ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারে। দেশপ্রেম, মমতা আর সততা আমাদের এখন শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ দিনে মনে পড়ে। আমাদের মরচে-পড়া দেশপ্রেমের চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে, আমাদের আপোসকামিতা থেকে মুক্ত হতে তোমাকে আমাদের খুব প্রয়োজন। আমাদের স্বার্থেই।
লেখক : সুমেল সারাফাত।।
কবির ছোট ভাই এবং রুদ্র স্মৃতি সংসদের সভাপতি,
মোংলা প্রতিনিধি, দৈনিক প্রথম আলো।
E-mail : sumel-74@live.com