কে আগে? ঢাকা নাকি রামপাল?
কেউ একজন আমাকে বলেছিলেন, ঢাকাতে জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে আর পরিবেশবাদীরা কোথাকার কোন রামপাল-কে বাঁচানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন।
আমি উত্তরে বললাম- ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য করার দায়ভার যাদের উপর মূলত বর্তায়, তারাই এখন রামপালের দিকে চোখ বাড়িয়েছে!
অনেকে বলেন পরিবেশবাদীরা আতেল, খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই, মানুষ বাঁচতে পারছে না, বন-জঙ্গল/বাঘ-হরিণের পিছনে দৌড়াচ্ছেন। সেসব “গো-মূর্খ”-দের উদ্দেশ্যে বলি, অনেক আগে আমরা এরকম নিজেদের দিক থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। সেই অনেক আগের সময়টা হল, ঢাকা যখন ধীরে ধীরে ব্যস্ত রাজধানীতে পরিণত হচ্ছিল। তখন আমরা শুধু বর্তমান আর অতীত নিয়ে ঘেঁটেছিলাম, ভবিষ্যত নিয়ে ভাবিনি, অথচ ঠিকই বিনোদনস্বরূপ “ভবিষ্যতের মানব”-দের পয়দা করে গিয়েছি।
ঢাকা এখন আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না, শত শত ফ্লাইওভার হলেও, হাজারখানেক মেট্রোরেল হলেও! ঢাকার পানি (চারটি নদীর পানি), ঢাকার বায়ুস্তরের বাতাস, মাটির উপরের কয়েকটি স্তর- সবই দূষণের অন্তিম পর্যায়ে।
আর ঢাকা শহরের এই দুরবস্থার জন্য ঢাকার বর্তমান বাসিন্দাদের উপরও খানিকটা দায় বর্তায়। উদাহরণস্বরূপ দুটো কথা বলতে গেলে- কেন আপনার ছেলেকে নটরডেমেই পড়তে হবে? কেন মেয়েকে ভিকারুন্নিসাতেই পড়তে হবে? কেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে বা ডাক্তারি পড়লে ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পড়তে হবে? লোক দেখানো শ্রেষ্ঠত্বের পিছনে আর কতদিন ছুটবেন, যেখানে অস্তিত্বই সংকটের মুখে?
প্রাকৃতিক দূর্যোগের ক্ষেত্রে খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে ঢাকা। এই “কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা ঢাকা”-কেই সচল রাখতে সভ্যতার চালিকাশক্তি বিদ্যুত সরবরাহের জন্য কেন সুন্দরবনকে বলি হতে হবে? অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা এই সভ্যতা কি প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে আদৌ সামনে চলতে পারবে? বিদ্যুত উৎপাদন ও ব্যবহারের যেমন একটা সামঞ্জস্য থাকা দরকার, ঠিক তেমনি প্রকৃতিতে প্রত্যেক জীবের ও উদ্ভিদের অস্তিত্বের উপরেই প্রকৃতির ভারসাম্য নির্ভর করে।
মানুষের উপর জোর খাটানো যায়, পরিবেশের উপর নয়। সেটা চেষ্টা করলে এমন এক “বুমেরাং” হয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসে, যা ধরা যায় না, যা আমাদের ঘায়েল করে মারাত্মকভাবে!
রামপাল কেন?
সুন্দরবন তথা বাংলাদেশকে রক্ষার তাগিদে সচেতন জনগণের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করব ভেবে “রামপাল” লিখে সার্চ দিলাম।
প্রথমেই আসল কয়েকটা “অর্জুন রামপালের” ফ্যানপেজ! এই অর্জুন রামপাল যেই দেশের নাগরিক, সে দেশ কিন্তু পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে বেশ “শো-অফ” ভূমিকা পালন করে আসছে। বছরে একবার অন্তত দেখাই যায় যে, কোন মিডিয়া সেলিব্রেটি বন্য জীববৈচিত্র্য নষ্ট করার দায়ে জেল-জরিমানা হচ্ছে। সেই দেশটাই কেন “পরিবেশবান্ধব বিদ্যুতপ্রকল্প”-কে এড়িয়ে গিয়ে অন্যসব বিষয়ের মত এই ক্ষেত্রেও পার্শ্ববর্তী দেশটার মাথায় “কাঁঠাল” ভেঙ্গে খেতে চাইছে, তা ফুটপাতের পথশিশুরাও হয়তো বুঝবে।
সবাই লংমার্চ ও আন্দোলনকারীদের কর্মসূচী/কর্মকাণ্ডকে “বামদলগুলোর” বলে পক্ষপাতদুষ্ট/প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। হতে পারে তাদের অধিকাংশই বামপন্থী কর্মী/সমর্থক, কিন্তু সর্বোপরি তারা মানুষ, তারা বাংলাদেশের মানুষ। শুধুমাত্র স্বার্থপর-মুনাফাখোর-সুবিধাবাদীরাই সুন্দরবনের এই কয়লাভিত্তিক পাওয়ার-প্ল্যান্টের সমর্থন করবে।
তাপমাত্রা একটু বাড়লেই জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, আর তখনই দিনে ১৬/১৭ ঘন্টা লোডশেডিং মানুষকে এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে “এই সময়ে সরকার-ও আমাদের মূলা দেখিয়ে চলে যাচ্ছে!” গাধাও আজকাল নিজেদের “মানুষ” বলে ভাবতে লজ্জা করে!
একের পর এক রিয়েল-এস্টেট প্রজেক্ট, বিশাল শপিং মল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক করে কোন লাভ নেই। গ্যাস-বিদ্যুত-জ্বালানী ছাড়া মানবসভ্যতার সবকিছুই “মাকাল ফলে” পরিণত হবে। এই সরকারের আমলে বেশ কিছু পাওয়ার-প্ল্যান্ট তৈরী হয়েছে বটে, কিন্তু বিদ্যুত উতপাদনের কাঁচামাল বা জ্বালানী (গ্যাসের) অভাবে সেগুলোর অধিকাংশই “শো-পিস” হিসেবে পরে রয়েছে।
সঠিক পরিকল্পনার অভাব সবক্ষেত্রে। দেশের মানুষকে প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণে বাধ্য করতে না পারলে ঢাকা-র মত পুরো বাংলাদেশ-ও শীঘ্রই “বসবাসের অযোগ্য” হিসেবে পরিণত হবে। ঢাকার পানি-বাতাস-মাটির মত সামাজিক বন্ধন ও পারিবারিক পরিবেশ অশোধনযোগ্য পর্যায়ে চলে গিয়েছে।
সর্বস্তরের মানুষ “সোনার হরিণ -শান্তির” খুঁজে অধিক অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে যার যার পেশা থেকে দুর্নীতি করে যাচ্ছে; এবং এভাবেই ঘরে আসছে অতিরিক্ত গ্যাস সিলিন্ডারের পয়সা, আইপিএস কেনার টাকা, সন্তানের প্রাইভেট টিউশনের খরচ, সিএনজি ড্রাইভারের ডাবল-ভাড়া প্রদানের সক্ষমতা, বেআইনী-অযৌক্তিক বাড়ীভাড়া দেয়ার সামর্থ্য !!
অভিভূত!
লেখক- আবীর চৌধুরী