প্রিয় সুন্দরবন বিপদে পড়েছে। কঠিন বিপদ। এমনিতেই গাছপালা-পশুপাখি-মানুষসহ তার যে জগৎটার অস্তিত্ব হুমকির মুখোমুখি। আর মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে এখন যুক্ত হয়েছে ১৩২০ মেগাওয়াটের বিশাল এক কয়লাভিত্তিক বিদুৎ প্রকল্প। সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে (সরকারি হিসাবে)।
তাই সুন্দরবনকে রক্ষার জন্যে আন্দোলন করছে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। অর্থনীতিবিদ, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত এই কমিটি একদিকে যেমন এই প্রকল্পের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির দিকগুলো চিহ্নিত করে দেখিয়ে দিয়েছে। আগামী ২৪ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন অভিমুখে লংমার্চ করবে কমিটি। তাতে সামিল হবেন হাজার হাজার মানুষ।
• কি হচ্ছে সুন্দরবনে?
ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসির সাথে বিদুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তিও হয়ে গেছে। জমি অধিগ্রহণ করে মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে এর আগেই। পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই। পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া যে শুধু সুন্দরবন কেন, কোন স্থানেই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো একটি রেড ক্যাটাগরির স্থাপনা নির্মাণের কথা ভাবাই যায় না, আইন ও সমর্থন করে না।
• অস্বচ্ছ চুক্তি, আত্মঘাতি চুক্তি :
রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হবে দুই দেশের সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি’ নামে একটি কোম্পানিও গঠন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অর্থায়ন করবে ১৫ শতাংশ পিডিবি, ১৫ শতাংশ ভারতীয় পক্ষ এবং ৭০ শতাংশ ঋণ নেওয়া হবে ভারতেরই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে। তার সুদের গুড় ভারতের ব্যাংকই খাবে। যে নিট লাভ হবে সেটা ভাগ করা হবে ৫০ শতাংশ হারে।
• আমাদের উৎপাদিত বিদ্যুত আমরাই বেশি দামে কিনব!
রামপালে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনবে পিডিবি। যদি কয়লার দাম প্রতি টন ১০৫ ডলার হয় তবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ৫ টাকা ৯০ পয়সা এবং প্রতিটন ১৪৫ ডলার হলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ৮৫ পয়সা। অথচ দেশীয় ওরিয়ন গ্রুপের সঙ্গে মাওয়া, খুলনার লবণচরা এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারায় তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের যে চুক্তি হয়েছে পিডিবির সঙ্গে, সেখানে সরকার মাওয়া থেকে ৪ টাকায় প্রতি ইউনিট এবং আনোয়ারা ও লবণচড়া থেকে ৩ টাকা ৮০ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কিনবে। সরকার এর মধ্যেই ১৪৫ ডলার করে রামপালের জন্য কয়লা আমদানি চূড়ান্ত করে ফেলেছে। তার মানে পিডিবি এখান থেকে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা দরে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনবে সেটা নিশ্চিত। অর্থাৎ চুক্তিটি অসম।
• লাভের গুড় খাবে ভারত, ক্ষতি সব বাংলাদেশে :
ভারত পক্ষের জন্যে এটি অনেক মুনাফার হলেও বাংলাদেশের সর্বনাশ করে ছাড়বে। সর্বনাশ প্রাকৃতিক আর্থিক সব দিক থেকেই । তুলনামূলক ভাবে বিদ্যুতের অতিরিক্ত দামের জন্য আর্থিক ক্ষতি হবে ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এরসাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত সম্ভাব্য ক্ষতি যোগ করলে মোট ক্ষতির পরিমান দাঁড়াবে ৫ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা।তাছাড়া সুন্দরবন ধ্বংস, ভয়াবহ পরিবেশ দুষণের মাধ্যমে খুলনা শহরসহ এই বিভাগের মনুষ্য ও বন্য প্রাণীর জীবন-জীবিকা-খাদ্য ইত্যাদির ভয়াবহ ক্ষতি টাকার অংকে নিরুপন করা দু:সাধ্য।
• মূর্খদের উন্নয়ন পরিকল্পনা :
জাতীয় কমিটি শুধু জনগণের নগদ টাকার লুটপাট না, প্রকল্পটিকে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচে বড় পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনার উদ্যোগ হিসেবেও। রামপালের বিদুৎ কেন্দ্রটি ১৩২০ মেগাওয়াটের। জাতীয় কমিটি দেখিয়েছে একটি ৫০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত প্রকল্প গড়ে ১০ হাজার টন সালফার ডাই অক্সাইড নির্গমন ঘটায়। সালফার ডাই অক্সাইড যে অম্লবৃষ্টি ঘটাবে তাই সুন্দরবনকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। পারদ আর একটি পদার্থ যা প্রাণীদেহের স্নায়ুতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করে মৃত্যুর কারণ ঘটায়। রামপালে যে বিপুল পরিমান পারদ নির্গমন ঘটবে সেটা সুন্দরবনের গোটা প্রাণীকূলকে অচিরেই বিনষ্ট করবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপজাত হিসেবে আসা তরল কয়লা বর্জ্য এবং ছাই; এতে আর্সেনিক, পারদ, ক্রোমিয়াম, এমনকি তেজষ্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামও থাকে। ৫০০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে ১ লক্ষ ২০ হাজার টন ছাই এবং ১ লক্ষ ৯৩ হাজার টন তরল কয়লা বর্জ্য উৎপাদিত হয়ে থাকে। এই বিপুল পরিমান বর্জ্য শোধন একটা ব্যয়বহুল এবং গুরুতর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।
বলা হচ্ছে ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থাকবে, কিন্তু এই ধরনের প্রকল্প দুর্ঘটনা একটি স্বাভাবিক ঘটনা, ছাই বাতাসে উড়ে গেলে, পানি চুইয়ে কিংবা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেলেই বিপর্যয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। সুন্দরবন শুধু প্রতিবেশগত অর্থেই স্পর্শকাতর না, খেয়াল রাখতে হবে যে এই এলাকাটি দুর্যোগপ্রবণও বটে। সিডর- আইলা মত এক একটি ঘুর্নিঝড় কি সমূহ বিপর্যয় ডেকে আনবে,তা বলাই বাহুল্য।
জাতীয় কমিটি তাদের প্রচার পত্রে বলেছে, “বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে জাতীয় স্বার্থ সর্বনাশকারী অতীতের একটি তুলনীয় প্রকল্প হ’ল ১৯৬০ এর কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প। সামান্য পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে দেশের একটি অংশে ভয়াবহ জাতিগত নিপীড়ন, বন, পাহাড় ধ্বংস, সরকারি বাহিনীর লুটপাট, আর্থিক লাভের তুলনায় সহস্রগুণ জাতীয় ক্ষতির একটি প্রকৃষ্ট উদাহরন এই চালু প্রকল্প।”
• বাংলাদেশে দূষণ রপ্তানি :
এমনকি জাতীয় কমিটির বিশেষজ্ঞরা জানায়, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২৫ কিমি এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়না। ভারতীয় কোম্পানী বাংলাদেশে সুন্দরবনের ৯-১৪ কিমির মধ্যে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে যাচ্ছ। অথচ ভারতেরই ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান অ্যাক্ট ১৯৭২’ অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধে কোন বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈব বৈচিত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্যকোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। গত কয়েকবছরে ভারত তিনটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করেছে এসব কারণে। অর্থাৎ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসিকে বাংলাদেশে সুন্দরবনের যত কাছে পরিবেশ ধ্বংস কারী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়া হচ্ছে, তার নিজ দেশ ভারতে হলে সেখানকার আইন অনুযায়ী তা তারা করতে পারতো না!
সুন্দরবন আছে বলে প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচে। সুন্দরবন মায়ের মতো নিজে সবাইকে আগলে রাখে। বিরল সুন্দরবনের বাঘ ছাড়াও ইরাবতি ডলফিন, সবুজ ব্যাঙ, লাল কাঁকড়ার আশ্রয় এই পৃথিবীর সর্ব বৃহত ম্যানগ্রোভ বন। সেই সুন্দরবন কতিপয় লুটেরার লোভে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, এখন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে এই তাকে হত্যা করার আয়োজন চলছে।
• লেখক- মাহবুব রশিদ
স্বত্ব ও দায় লেখকের…